ডেস্ক নিউজ : করোনায় উচ্চঝুঁকিপূর্ণ আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সূচকরেখা যেভাবে উঠানামা করছে, তার সঙ্গে মিল দেখা যায় না অন্য বেশির ভাগ দেশের পরিস্থিতির। উচ্চঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো থেকে বাংলাদেশের চিত্রও অনেকটা এমন। বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের গতি জুন মাসজুড়ে এক ধাপ চূড়ায় উঠে সমান্তরাল ছিল টানা তিন সপ্তাহ। আর মৃত্যুসূচকের গতি আড়াই মাস ধরে চলছে প্রায় সমান্তরাল রেখায়। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও এর উল্টো পিঠে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ‘বিস্ফোরণ ঝুঁকিও’ থেকে যায় বলে মত দিয়েছেন।
রোগতত্ত্ববিদ ও আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্বের মাত্র ১০-১২টি দেশ হঠাৎ করে প্রায় একলাফে সংক্রমণ ও মৃত্যুর চূড়ায় উঠে গিয়েছিল। এই কাণ্ড হয়েছে ওই সব দেশে প্রথম দিকে মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। অর্থাৎ আমেরিকা ও ইউরোপের মতো দেশগুলো মহামারিকে পাত্তা দেয়নি। এর ফলে তাদের ভুগতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। লাফ দিয়ে উঠে নিচে নামার বিষয়টি এমন নয় যে সংক্রমণ বা মৃত্যু থেমে গেছে, বরং কোথাও কোথাও আবার নতুন করে সংক্রমণের চিত্র আমরা দেখছি। অন্যদিকে বাকি বেশির ভাগ দেশেই সংক্রমণ ও মৃত্যুতে ধীরগতি রয়েছে। বৈশ্বিক সূচক রেখা সমান্তরালভাবে চলার মধ্য দিয়ে এর প্রতিফলন ঘটছে। তবে বাংলাদেশসহ এসব দেশে এ ক্ষেত্রে শঙ্কা হচ্ছে, ওই রেখা ওপরে না উঠলেও নিচেও নামছে না।’ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘নিচে নামার জন্য আমাদের যেভাবে চেষ্টা থাকা দরকার, সেটি আরো জোরালো করতে হবে। তা না হলে এই অবস্থা আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংক্রমণ ও মৃত্যু সূচকের রেখাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের ধারা নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠেছে ধীরে ধীরে। এখনো একই ধারায় উঠছে। আবার মৃত্যুর হার গত মার্চ মাসে বৈশ্বিক সূচকে এক দফা বেশি ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এপ্রিলে তা নিচের দিকে নামতে শুরু করে। আর মে থেকে তা এখন পর্যন্ত একই সীমারেখায় মৃদুগতিতে উঠানামা করছে। ঠিক বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মে মাস থেকেই মৃত্যুর সীমারেখা ৩০ থেকে ৫০-এর মধ্যে মৃদুগতিতে উঠানামার মধ্যে আছে। ব্যতিক্রম হিসেবে দু-তিন দিন এর ওপরে বা নিচে নামার ঘটনা রয়েছে। সপ্তাহের হিসাবেও একই ধরনের চিত্র স্পষ্ট। যেমন জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে শনাক্ত-পরবর্তী তিন সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ২৫ হাজারের ঘরে ছিল। এরপর আবার নেমে সপ্তাহে ২০ হাজারের ঘরে থাকে। অন্যদিকে মৃত্যুর ক্ষেত্রে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহ পর্যন্ত সপ্তাহে ২৭০ থেকে ৩০৮ জনের মধ্যে অবস্থান করছিল। খুব বেশি নিচেও নামেনি আবার ওপরেও ওঠেনি। পরে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে মৃত্যুরেখা অনেকটা নিচে নেমেছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরীক্ষা পর্যাপ্ত না হলেও কিছু সূচক দেখলেই বোঝা যাবে যে আমাদের দেশে সংক্রমণ কোন পথে আছে। যেমন গত কয়েক দিনে আগের তুলনায় ৫০ বছরের নিচের বয়সীদের মৃত্যু তুলনামূলক কমে গেছে। আবার তরুণ প্রজন্ম বেশি আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে খুবই কম। ফলে মনে হচ্ছে ভাইরাস তার চরিত্র পরিবর্তন করেছে। তবে এটাও ঠিক যে আমাদের এখানে বেশ কয়েক দিন ধরে রি-প্রডাকশন (একজন থেকে আরেকজনে ছড়ানো) হার ০.৯৯-তে থেমে আছে। এটা কমছে না। তাই আমরা কিন্তু শঙ্কিত, সামনে ঈদের সময় যদি জনচলাচল নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আবার পাল্টে গিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়তে পারে।’ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশ এখন ভালো একটি লাইনআপে আছে, যেখানে আমাদের মৃত্যুসূচক খুবই ধীরে চলছে। সংক্রমণ উঠানামা করলেও তাতেও এক ধরনের ধীরগতি আছে। পরীক্ষা কম হলেও এর প্রভাব বোঝা যায়। অর্থাৎ অনেক বেশি পরীক্ষা হলেও এখানে হঠাৎ সংক্রমণ লাফ দিয়ে এখনো বেশি উঁচুতে উঠার মতো অবস্থা হয়নি। তবে সামনে ঝুঁকি যে নেই সেটি কিন্তু আমরা বলতে পারছি না। অন্যদিকে মৃত্যু আমাদের এখানে কম বলে সন্তুষ্টিতে ভুগে আমরা যেন নিজেদের বিপদ ডেকে না আনি। কম মৃত্যু দেখে সবাই যদি বেপরোয়া হয়ে চলতে থাকি, তবে কিন্তু যেকোনো সময় সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।’