ডেস্ক নিউজ : স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে প্রথম বাঙালি হিসেবে ভারতের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বন্ধু হয়ে ছিলেন পাশে।
পশ্চিম বাংলার এই কংগ্রেস নেতা একাত্তরে পাশে দাঁড়িয়ে এপার বাংলার মানুষকেও কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। তার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেওয়া হয়।
বিয়ের সূত্রেও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধনে জড়িয়ে ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, তার স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় ছিলেন বাংলাদেশের নড়াইলের সন্তান। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে এসে নড়াইলের ভদ্রবিলায় শ্বশুরালয়েও ঘুরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ‘জামাইবাবু’ প্রণব মুখোপাধ্যায়।
মুক্তিযুদ্ধকালে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কংগ্রেসের নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন রাজ্যসভার সদস্য। ভারতের অনেক রাজনীতিকের মতো তখন মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ফ্রান্সে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি।
একই সময়ে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি সফরে গিয়ে সেখানকার সরকার প্রধান ও সংসদ সদস্যদের কাছে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি উপস্থাপনে ভূমিকা রাখেন তিনি।
ওই সময়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো করায় ভূমিকা রাখেন তিনি।
নিজের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড: দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ এ একটি অধ্যায়ই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।
প্রণব লিখেছেন, ‘বাজেট অধিবেশন চলাকালে আমি রাজ্যসভায় বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। আমি সংসদকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।’
এদিকে প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে শোকে আপ্লুত ও স্মৃতিকাতর হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও শেখ হাসিনার নিজের বহু স্মৃতি প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন।
এক শোকবার্তায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনও বিস্মৃত হবার নয়। আমি সবসময় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি আমাদের সবসময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন, যেকোন প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশের ফেরার পরও প্রণব মুখার্জি সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যেকোন সংকটে তিনি সাহস যুগিয়েছেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারালো একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারালো একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।’
প্রসঙ্গত, ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান আর আইনে মাস্টার্স শেষ করে কলেজ শিক্ষক আর সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন প্রণব মুখার্জি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে তুলে এনেছিলেন রাজনীতির শীর্ষে, হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবন তার। নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেলেও সবসময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিলেন তিনি।
পরে পাঁচ দশকের রাজনীতির পথ পাড়ি দিয়ে ২০১২ সালে ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যও আলোচনায় এসেছিলেন, তবে হতে পারেননি। তবে মেয়াদ শেষে অবসরের পর তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়াননি।
বৈশ্বিক রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা আর কৌশলের কারণে প্রণব মুখার্জি পরিণত হয়েছিলেন একজন বড় মাপের শিক্ষকে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কীভাবে পাল্টাচ্ছে, ভারত বা এশিয়ার জন্য তার তাৎপর্য প্রভাব কেমন হবে- এগুলো নিয়ে তার বিরাট দক্ষতা, এটা ছিলো তার বিরাট গুণ। তাকে না জিজ্ঞেস করে ইন্দিরা গান্ধী বা মনমোহন সিং কিছুই করতেন না। এমনকি নরেন্দ্র মোদীও তার কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। সুতরাং তিনি একজন বড় রাজনীতিক সেটা সবাই জানে।
বাবার পথ ধরে শুরুতে রাজনৈতিক দল কংগ্রেসে যোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও স্থানীয় নেতারা তাকে সে সুযোগ দেননি। পরে কংগ্রেস থেকেই বেরিয়ে আসা অজয় মুখার্জীর বাংলা কংগ্রেসে যোগ দেন। কিন্তু তার মেধা আর জ্ঞানে আকৃষ্ট হয়ে ১৯৬৯ সালে অজয় মুখার্জী তাকে রাজ্যসভার সদস্য করে পাঠান।
এবিষয়ে তার দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলেছেন, মূলতঃ রাজনীতিক প্রণব মুখার্জি আলো ছড়াতে শুরু করেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতীয় পার্লামেন্টে তাঁর তৎপরতার মাধ্যমেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই বড় কারণ প্রণব বাবুর জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশে। ইন্দিরা গান্ধী তার মেধায় আকৃষ্ট হয়ে তাকে কংগ্রেসে নেন ও বড় বড় নেতাদের রেখে তাকেই নাম্বার টু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এক সময় তাকে ইন্দিরা গান্ধীর মানসপুত্র বলা হতো। অতি অল্প বয়সে ১৯৮২ সালে তাকে অর্থমন্ত্রী করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
তবে সেই কংগ্রেস থেকেও তাকে বেরিয়ে ভিন্ন দল করতে হয়েছিলো গান্ধী পরিবারের সাথে বিরোধের জের ধরেই। যদিও পরে আবারো ফিরে আসেন তিনি কংগ্রেসে। পাঁচবার রাজ্যসভায় গিয়েছেন আর লোকসভায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সালে, যা তাকে পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।
নিজের বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার আলোকে বই লিখেছেন অন্তত আটটি। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইয়ে বাংলাদেশে ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পেছনের ভূমিকাও উঠে এসেছিলো। ভারতে কংগ্রেসের বাইরেও উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তার গ্রহণযোগ্যতা তাকে রাজনীতিতে বিশেষ মর্যাদায় তুলে এনেছিলো।
প্রণব মুখার্জীর জীবন রাষ্ট্রপতি হওয়া পর্যন্ত উত্থানপতন ও টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই গেছে। কংগ্রেস যখন ২০০৪ সালে ক্ষমতায় আসে ওই সময় থেকে প্রণব ছিলেন রাজনৈতিক পরিপক্বতার তুঙ্গে। পরে তিনি অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি সবাইকে নিয়ে রাজনীতির চেষ্টা করেছিলেন বলে তাকে রাজনীতির চাণক্য নামে অভিহিত করা হয়।
যে কোন সংকটময় মূহুর্ত থেকে উত্তরণে তার তৎপরতায় বারংবার ঋদ্ধ হয়েছে ভারতের রাজনীতি। কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়েই তিনি ভারতের রাজনীতিতে বিরোধী দলগুলো এমনকি বিজেপি নেতাদেরও শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
দল-মত নির্বিশেষে অজাতশত্রু ভদ্রলোক রাজনীতিকদের কাতারে সম্ভবত তিনিই ছিলেন শেষ ব্যক্তিত্ব। দল ভুলে, রং ভুলে সবাই তার কাছে যেতেন রাজনৈতিক সংকটমোচনের পরামর্শ নিতে। সুতারাং একথা বলাই যায়- তার মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান ঘটলো।