ডেস্ক নিউজ : মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের মূল খুঁটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে নানা বিরোধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তবে বিরোধের বড় কারণ হয়ে দেখা দেয় বালুমহাল, জলমহাল, খাসজমি, নদীর পার, বাজার ও খেয়াঘাট ইজারার মতো অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো। এসবের ওপর লোভাতুর চোখ থাকে প্রভাবশালীদের। ওই সব জায়গায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নিতে গেলেই খেপেন ক্ষমতাবানরা। শুরু হয় দ্বন্দ্ব, বিপাকে পড়তে হয় কর্মকর্তাদের। প্রশাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা সব কিছুর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করতে চান। সরকারি স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে টার্গেট হয় প্রশাসন। গত ছয় বছরে অন্তত ৯ জন ইউএনওর ওপর হামলার তথ্য পাওয়া গেছে।
গত মে মাসে বালু দস্যুদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকালে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক হামলার শিকার হন। উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলের পশুরবুনিয়া স্পটে বালু উত্তোলনকারীদের ওই হামলার ঘটনায় মামলাও হয়েছে। গত রবিবার ইউএনও মোহাম্মদ শহিদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয় একটি রাজনৈতিক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় আমার ওপর হামলা হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দল পাল্টালেও বালু সন্ত্রাসীরা একই থাকে। আইন অনুযায়ী সরকারি স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে খেপে যায়।’ কলাপাড়া থানার ওসি খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে, শিগগিরই চার্জশিট দাখিল করা হবে। তবে কবে নাগাদ চার্জশিট দাখিল করা যাবে, তা জানাতে পারেননি ওসি।
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে কয়েক দিন আগে ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর আক্রমণের কথা সবার জানা। বছর পাঁচেক আগে এর পাশের উপজেলা নবাবগঞ্জের ইউএনও সৈয়দ ফরহাদ হোসেনের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর দিনে-দুপুরে ঘটা ওই ঘটনার শিকার ফরহাদ হোসেন বর্তমানে রংপুর জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর ওপর হামলার ঘটনায় একটি মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় হাজিরা দিতে গেলে ২৪ জন আসামিকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মামলাটি চলমান, তবে আসামিরা এখন জামিনে আছেন। ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলাটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে। মামলার আসামিরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মী।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও ইসমাইল হোসেন তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে গিয়ে সেখানে বেশি দিন টিকতে পারেননি। স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের অনিয়মের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে রাজি হননি তিনি। এক পর্যায়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দুর্বৃত্তরা তাঁর ওপরে হামলার উদ্দেশ্যে তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করে। বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিজি প্রেসে কর্মরত ইসমাইল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, হামলাকারীরা ক্ষমা চাওয়ায় মামলা আপস হয়ে গিয়েছিল।
বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব সরকারের আমলেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্তদের লালনের সংস্কৃতি দেখে আসছি। দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্তদের শক্ত অবস্থান না থাকলে কিছুই হয় না। ইউএনওকে আক্রমণের ঘটনায় হয়তো সুষ্ঠু তদন্ত হবে, তাঁদের ক্ষমতা আছে। এমন ঘটনা অহরহ হচ্ছে, কই সেগুলোর বিষয়ে কোনো হৈচৈ আছে?’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, হৈচৈ আরেকটা কারণে হয়, যদি কোনো কারণে শীর্ষস্থানীয় কারো বিরাগভাজন হন তখন দু-একজন দুর্বৃত্ত ধরা পড়ে। যেমন—ঢাকার ক্যাসিনো সম্রাটরা, ফরিদপুরের দুই ভাই দৃষ্টান্ত হতে পারে।’
২০১৬ সালের ৩১ মার্চ দুর্বৃত্তদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার ইউএনও হাবিবা শারমিন। ওই দিন উপজেলার কাকিলাকুরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে খামারপাড়া কেন্দ্রে ব্যালটবাক্সসহ আটকে পড়া প্রিসাইডিং অফিসারকে স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে ফেরার পথে ইউএনওর গাড়িতে হামলা চালানো হয়। ইউএনও এবং তাঁর ড্রাইভারের মাথায় আঘাত লেগেছিল। এ ঘটনায় হওয়া মামলাটি শ্রীবরদী আমলি আদালতে বিচারাধীন। একই দিন ভেলুয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শ্রীবরদী পৌরসভার মেয়র নির্বাচনী আইন ভঙ্গ করায় ইউএনও হাবিবা শারমিন তাঁকে আইন মেনে চলার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিপরীতে পৌর মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাঈদ ইউএনওকে হুমকি-ধমকি দিলে ইউএনও নির্বাচনী কাজে বাধা ও নিজের নিরাপত্তা চেয়ে মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। হাবিবা শারমিন বর্তমানে শিক্ষা ছুটিতে দেশের বাইরে আছেন বলে জানা গেছে।
এভাবে হামলা ও হুমকির শিকার হতে হয় মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা তথা ইউএনওদের। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার ইউএনও ছিলেন তারিক সালমন। ২০১৭ সালে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের তত্কালীন ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ওবায়দুল্লাহ সাজুর করা মিথ্যা মামলায় দুই ঘণ্টার কারাবাসের পর শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে তিনি অভিযোগমুক্ত হন। বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন তারিক সালমন।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ইউএনও ছিলেন মৌসুমী জেরীন কান্তা। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মাথায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বিতণ্ডায় চলতি বছরের মে মাসে স্টেশন ছাড়েন। এই বিষয়ে জেরীন কান্তা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে অবৈধ ক্রাশার মিলের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে হামলার শিকার হয়েছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ইউএনও আজিজুল ইসলাম। গত বছরের নভেম্বরে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ইউএনও ইকবাল হোসেনকে নদী দখলদারদের হামলার কবলে পড়তে হয়েছিল।
শুধু মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারাই নন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের রোষানল থেলে রেহাই পায় না তাঁদের পরিবারও। গত বছরের জুলাই মাসে পিরোজপুর সদর উপজেলার এসি ল্যান্ড রামানন্দ পালের স্ত্রী অদিতি বড়াল দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে আহন হন। খোদ পিরোজপুর জেলা প্রশাসনের ডরমিটরিতে এ ঘটনা ঘটেছিল। এরপর রামানন্দ দম্পতি ভয়ে ওই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় পোস্টিং নিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট বিভাগের একজন ডিসি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাঠে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির। ক্ষমতাসীন দলের সুবিধাবাদী অংশটি নানা সুবিধার খোঁজে থাকে। আর অবৈধ কাজে বাধা দিলে প্রশাসনকে প্রতিপক্ষ মনে করে। ইউএনওরা প্রায়ই অভিযোগ করে, কিন্তু সমাধান দিতে পারি না। ওপরের পর্যায়ে জানালে আমাদের সমন্বয় করে চলার জন্য বলা হয়।’ বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জলমহাল, বালুমহালগুলোতে আগে সংশ্লিষ্ট লোকজনই সম্পৃক্ত থাকত। স্থানীয় প্রশাসনকে তেমন হস্তক্ষেপ করতে হতো না। বর্তমানে রাজনৈতিক পরিচয়ের আশ্রয় নিয়ে সেগুলো দখলের চেষ্টায় থাকে। সরকারি স্বার্থ রক্ষায় প্রশাসন উদ্যোগ নিলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘অফিসারদের ওপর আগের হামলাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এমন ঘটনা ঘটত না।’