বিনোদন ডেস্ক : সরলা দেবী চৌধুরানী ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিক, সমাজসেবক ও বুদ্ধিজীবী। নামেই তিনি মনে রোমাঞ্চ জাগান। সরলা দেবী চৌধুরাণী বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জানকীনাথ ঘোষাল এবং বাংলার প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক ও রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবীর সন্তান।
সরলা দেবী চৌধুরানীর জন্ম ১৮৭২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর মাতুলালয় কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। পিতার বিলাত প্রবাসকালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তার শৈশব কাটে। তার পিতা জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন নদীয়ার জয়রামপুরের জমিদার এবং জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা; মাতা রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা সাহিত্যিক স্বর্ণকুমারী দেবী।
সরলাদেবী কলকাতার বেথুন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৮৬), বেথুন কলেজ থেকে এফএ (১৮৮৮) এবং ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ (১৮৯০) পাস করেন। বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে তিনি ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। তিনি সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও তার বেশ খ্যাতি ছিল এবং তিনি শতাধিক স্বদেশপ্রেমের গান রচনা করেন।
সরলাদেবী মহীশূরের মহারাণী গার্লস স্কুলে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ (১৯০৩) ও ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ পালন করেন। যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলার প্রথম গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনে তিনি সহায়তা করেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁতবস্ত্র প্রচার ও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার (১৯০৪) স্থাপন করেন। ১৯৩০ সালে তিনি লাহোর থেকে প্রকাশিত উর্দু পত্রিকা হিন্দুস্থান-এর সম্পাদক ও পাঞ্জাবের আর্যসমাজের নেতা পণ্ডিত রামভজ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই সূত্রে তিনি পাঞ্জাবের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে পর্দানশীন মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হন; তাঁর প্রচেষ্টাতেই ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল’।
কলকাতায়ও তিনি অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান ‘ভারত স্ত্রীশিক্ষা সদন’ (১৯৩০) গড়ে তোলেন; মহিলাদের মধ্যে তরবারি চালনা, লাঠি খেলা ইত্যাদি প্রচলিত করেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূত্রে লালা লাজপত রায়, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, বালগঙ্গাধর তিলক, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখের সঙ্গে সরলাদেবীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তিনি গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সমর্থন করেন। ১৯৩৫ সালে শিক্ষাজগৎ থেকে অবসর নিয়ে তিনি ধর্মীয় জীবনে ফিরে আসেন। প্রথম জীবনে থিওসফিক্যাল সোসাইটি এবং পরে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হলেও শেষজীবনে তিনি বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মাকে গুরুপদে বরণ করেন।
ভারতী, সখা ও বালক পত্রিকায় রচনা প্রকাশের মাধ্যমে সরলাদেবীর সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও সরলাদেবী কৃতিত্বের পরিচয় দেন। স্বামী রামভজ রাজরোষে গ্রেপ্তার হলে তিনি হিন্দুস্তান পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং এর ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশ করেন। অগ্রজা হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি দীর্ঘকাল ভারতী পত্রিকাও সম্পাদনা করেন।
সরলাদেবী রচিত ১০০টি দেশাত্মবোধক গানের একটি সংকলন গ্রন্থ শতগান ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: বাঙালির পিতৃধন (১৯০৩), ভারত-স্ত্রী-মহামণ্ডল (১৯১১), নববর্ষের স্বপ্ন (গল্প, ১৯১৮), জীবনের ঝরাপাতা (আত্মজীবনী, ১৯৪৫), বেদবাণী (১১ খণ্ড), শিবরাত্রি পূজা ইত্যাদি। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তার মৃত্যু হয়।
রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার পীরগাছা রেল স্টেশনের পাশেই অবস্থান দেবী চৌধুরানী জমিদার বাড়ি। বিশাল এলাকা নিয়ে ছড়ানো ছিটানো এ রাজবাড়ির অসংখ্য দালান আজ ধ্বংস প্রায়। দালানের ইট,পাথর ও সুরকি খুলে পড়েছে। দেয়ালের জীর্ণতা ও শেওলা জমাট বেঁধেছে। রাজবাড়ির চারি দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দৃষ্টি নন্দিত ছোট বড় অনেক পুকুর। বাড়ির পিছনে ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে কোনমতে বেঁচে আছে দেবী চৌধুরানীর খননকৃত ঢুসমারা খাল।
দেবী চৌধুরানী এই খাল দিয়ে নৌকাযোগে নদী পথে বিভিন্ন গোপন অবস্থায় যাতায়াত করতেন বলে জনশ্রুত রয়েছে। ধ্বংস প্রায় জমিদার বাড়ির নাট্য মন্দির ও কাচারীটি পীরগাছা উপজেলার সাব রেজিস্ট্রি অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জমিদার বাড়ীর মধ্যে নির্মিত বহু মন্দির আজ আর নেই। তবে ছোট তরফের জমিদার ভৈরবেন্দ্র নারায়ণ কর্তৃক নির্মিত ত্রি বিগ্রহ মন্দিরটি যেন ধ্বংসের অপেক্ষায় দিন গুনছে। সেখানে অন্নপূর্ণা বিশ্বেশ্বর , শিবমন্দির ও হরিহর তিনটি বিগ্রহ এক মন্দিরের পাশাপাশি কক্ষে স্থাপন করা হয়েছে। যা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।