রবিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জেনে নিন রক্তে চর্বির পরিমাণ কিভাবে কমাতে পারেন?

প্রতিটি মানুষের রক্তে নির্দিষ্ট মাত্রায় চর্বি থাকে। কিন্তু এই চর্বির পরিমাণ যখন বেড়ে যায় তখন বেড়ে যায় অনেক মারাত্মক রোগের ঝুঁকি। রক্তে অতিমাত্রার চর্বি করোনারি আর্টারি ডিজিজ বা হূদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

আসুন প্রথমে জেনে নেয়া যাক রক্তের চর্বির স্বাভাবিক মাত্রা কত। এটা আমরা লিপিড প্রফাইলের মাধ্যমে জানতে পারি। টোটাল কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা ধরা হয় ২২০ মি.গ্রাম/ডিএল পর্যন্ত বা 5.2 mmol/L আর ট্রাইগ্লিসারাইড 50-150 mg /dl পর্যন্ত স্বাভাবিক বা 2.3 mmol/HDL বা হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনকে বলা হয় ভালো কোলেস্টেরল, এটা বেশি থাকাই কাম্য। HDL 35mg /dl বা 0.9 mmol/L এর কম হলে সেটা ভালো নয়। এবারে আমরা জেনে নেবো কিভাবে আমরা রক্তে চর্বির পরিমাণ কমাতে পারি বা কম রাখতে পারি। প্রথমেই বলা যাক খাদ্যতালিকায় কী কী সংযোজন বা পরিহার করতে হবে।

গরু ও খাসির গোশত খাওয়া কমিয়ে দিন। আর, হ্যাঁ, সেই সাথে অবশ্যই কলিজা জাতীয় খাবারও আপনাকে কম খেতে বা খাওয়া বন্ধ করতে হবে। প্রচুর মপরিমাণে মাছ খান। শাকসবজি ও ফল খান। দুধ বা দুধ থেকে উত্পন্ন খাদ্য যেন- ঘি, পনির, মাখন, আইসক্রিম খাবেন না। ডিমের কুসুম বাদ দিয়ে খাবেন, তার মানে শুধু ডিমের সাদা অংশ খেতে হবে। নারকেল বা নারকেল দেয়া খাবার পরিত্যাগ করুন। খাবার তালিকা সংশোধনের সাথে সাথে হূদরোগ-এর ঝুঁকি বাড়ায় এমন কোনো অভ্যাস যেমন ধূমপান পরিহার করতে হবে। তাছাড়া উচ্চরক্তচাপ থাকলে তার জন্য সঠিক চিকিত্সা নেয়া জরুরি।

এরপর আসা যাক অ্যারোবিক এক্সারসাইজের কথায়। ব্যায়াম করার আগে চিকিত্সকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন ব্যায়াম করা স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন। এবার আসা যাক অ্যান্টি আক্সিডেন্ট ভিটামিনের কথায়। ভিটামিন এ, ই ও সি হচ্ছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ভিটামিন। নানাভাবে এরা রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমায় ও হূদরোগের ঝুঁকি কমায়।

ভিটামিন এ রয়েছে রঙিন শাক সবজিতে। আর প্রতিদিন অন্তত ১৫ গ্রাম ভিটামিন এ আমাদের জন্য প্রয়োজন। তাই ভিটামিন সমৃদ্ধ প্রচুর পরিমাণ কাঁচা ও রান্নাকরা শাকসবজি, ফল গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, তারপরও রক্তে কোলেস্টেরল বা চর্বির পরিমাণ বেশি এ রকম অনেকেই আমাদের কারো না কারো পরিবারে আছেন। আর তাদেরকে তখন নানারকম ওষুধের মাধ্যমে রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

৫০ বছর এর অধিক বয়সী অনেক মহিলার সার্জারি করে জরায়ু ফেলে দেয়া হয়। আবার সে সময় তারা এমনিতেই মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি কালে চলে যান। এই সময় তারা যদি ইস্ট্রোজেন নেন তাহলে তারা হূদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারেন। কারণ ইস্ট্রোজেন বা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি দেয়া হলে তা কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। যেসব ওষুধ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় তা চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাইল এসিড রেজিন, নায়াসিন, স্ট্যাটিন এবং ফিব্রিক এসিড থেকে প্রাপ্ত ওষুধ।

১। বাইল এসিড রেজিনকে প্রথম ধাপের ওষুধ বলা হয়। এই ওষুধ কোলেস্টেরল এবং বাইল এসিডের সাথে সংযুক্ত হয় অন্ত্রে এবং কোলেস্টেরলের শোষণ কমায়। এতে করে লিভার রক্ত থেকে বেশি পরিমাণ এলডিএল বা লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন শুষে নেয়। এতে করে ২৫-৩০ ভাগ এলডিএল কমে যেতে পারে। বাইল এসিড রেজিনের সুবিধা এই যে, এটা দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। তবে এটা খেলে প্রচুর পরিমাণ পানি পান ও আশযুক্ত খাবার খাওয়া ভালো এবং এতে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।

২। নায়াসিন বা নিকোটিনিক এসিড বি ভিটামিন। এটি ঠিক কিভাবে রক্তের চর্বির পরিমাণ কমায় তা জানা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, লিভারের এলডিএল কোলেস্টেরল তৈরিতে এটা বাধা দেয়। এটি ১৫-২০ ভাগ এলডিএল কমাতে পারে। এবং ২০-৩৫ ভাগ এইচডিএল-এর পরিমাণ বাড়ায়।

নায়াসিনের কর্মক্ষমতা ভালো কিন্তু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন- মাথা ব্যথা, চুলকানি, মুখ চোখ ঝাঁঝাঁ করা ইত্যাদি। তবে নায়াসিন খাবার আগে ৩২৫ মি.গ্রাম অ্যাসপিরিন খেলে এগুলো কম হবে। নায়াসিন নেয়ার আগে এটাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, লিভার ঠিকমতো কাজ করছে কি না।

৩। স্ট্যাটিন বা এইচএমজি কো-এ রিডাকটেজ ইনহিবিটর-এর মধ্যে রয়েছে লোভাষ্ট্যাটিন, সিমভাস্ট্যান্টিন, প্রাভাস্ট্যাটিন, ফ্লুভাস্ট্যাটিন। নতুন আবিষ্কৃত অ্যাটরভ্যাস্টিন এবং

সারভিস্ট্যাটিন। এগুলো লিভারে কাজ করে, এরা কোলেস্টেরল তৈরিতে বাধা দেয়। এতে করে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে যায়। স্ট্যাটিন নেয়ার আগেও লিভারের কার্যক্ষমতা দেখে নিতে হবে।

কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন- মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে মাংসপেশিতে ব্যথা। এই ওষুধ প্রতিদিন দিন সন্ধ্যায় একবার গ্রহণ করলেই হয়।

৪। ফিব্রিক এসিড থেকে উত্পন্ন জেমোফ্রিব্রেজিল সাধারণত ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে ব্যবহূত হয়। এটি ৩০-৬০ ভাগ ট্রাইগ্লিসারাইড কমায়। ১০-৩০ ভাগ পর্যন্ত এইচডিএল বাড়ায়। জেমোফ্রিব্রেজিল প্রায় সব রোগীদেরই সহ্য হয় তবে কারো কারো ডায়রিয়া, শরীরে ফুসকুড়ি ওঠা এসব হতে পারে। তা ছাড়া ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। আগে পিত্তথলির অসুখ হয়েছে এমন রোগীর জন্য নয় এটি।

জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হূদরোগের হাত থেকে রেহাই পেতে রক্তে কোলেস্টেরলের মান বা চর্বির মাত্রা অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত রাখা প্রয়োজন। এবং মনে রাখা দরকার যে, সেটি করতে হলে প্রথমেই নজর দিতে হবে আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার দিকে। বর্জন করতে হবে অনেক কিছু আবার গ্রহণ করতেও হবে বাড়তি কিছু। আর লিপিড প্রফাইল করে জেনে নিতে হবে সব কোলেস্টেরলের মাত্রা।

ডা. ওয়ানাইজা
সহযোগী অধ্যাপিকা
ফার্মাকোলজি অ্যান্ড থেরাপিউটিক্স ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ
চেম্বার: দি বেস্ট কেয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার
২০৯/২, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা/ কৃতজ্ঞ/ কালের কণ্ঠ

এই বিভাগের আরো খবর