স্বামীর সঙ্গে রাত-দিন খিটিমিটি লেগেই আছে। আপনি ভাবছেন, জীবনের সবচেয়ে আস্থাভাজন মানুষটি দূরে সরে যাচ্ছে। ভুল। এমনও তো হতে পারে, তিনি আপনাকে হারিয়ে ফেলছেন!
এ জন্য শুধু নিজেকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। জীবনসঙ্গীকেও না। বিবাহিত জীবনে একটু-আধটু ঝগড়া হওয়াটা স্বাভাবিক। এতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ভূমিকা থাকে। ঠোকাঠুকির তিলটা যখন তাল হয়ে যায়, তখন পাকিয়ে যায় জট। দেখা যায়, একই ছাদের নিচে থেকেও একজন আরেকজনের অচেনা।
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাম্পত্য কলহে এখনো স্ত্রীদের সমস্যাই বেশি। কর্মজীবী নারী হলেও একই কথা খাটে। কেননা এ দেশের সামাজিক পরিস্থিতি অনুযায়ী, স্ত্রীরা মনের দিক থেকে এখনো স্বামীর ওপর নির্ভরশীল।
এ জন্য দাম্পত্য বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই বেশি প্রাধান্য পায়। কিন্তু জীবনসঙ্গী যদি এরপরও দূরে সরে যেতে থাকে, তাহলে!
তখন সেই মেয়েটির মতো অসহায় আর কেউ নেই। সে তো নিজ ঘরেও পরবাসী! আর তাই স্বামীর প্রতি অভিমান হয়, রাগে গা জ্বলে এবং সেই রাগ ঝরে পড়ে হাজারো অব্যক্ত অনুযোগের অশ্রুবিন্দু হয়ে। বাঙালি মেয়েদের এটাই চিরাচরিত স্বভাব। বিরহ দহনে তিনি পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হবেন, কিন্তু এটা ভাববেন না ওই মানুষটিও হয়তো জীবনসঙ্গীর অপেক্ষায়—
তিনি এসে তাঁর অভিমান ভাঙাবেন। ব্যক্তিত্বের দ্বৈরথ আর কথা-কাটাকাটির গলি-ঘুপচিতে তিনিও তো আপনাকে হারিয়ে ফেলতে পারেন!
দাম্পত্য জীবনে কলহ মেটানো অনেক সময় জাদুর চেয়েও চমকপ্রদ ও কঠিন। জীবনসঙ্গীকে ফিরে পেতে চাইলে সবার আগে আপনাকে বাস্তববোধ সম্পন্ন হতে হবে। কেউ দূরে সরে যেতে চাইলে প্রথমে তাঁকে যেতে দিন।
বাঙালি মেয়েদের জন্য এটা খুবই কঠিন কাজ, কিছু ক্ষেত্রে অসম্ভব। তবে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের মানসিক দিক থেকে শক্ত হওয়ারও বিকল্প নেই। এক ঘরে থেকেও তাঁর সঙ্গে পারতপক্ষে মানসিক যোগাযোগটা কমিয়ে দিন। কথা বলা কমান। এটা বোঝান যে অভিমানটা তাঁর শুধু একার নয়; আপনারও আছে।
কিন্তু সাংসারিক কাজ-কর্ম কিংবা সন্তান লালন-পালনে এতটুকু ঢিল দেবেন না। শুধু তাঁর ব্যাপারে আগ্রহের পারদটা নিচে নামান। এতে আপনার অবস্থানটা পরিষ্কার হয়ে যাবে—
আপনি সংসার চান, তাঁকেও চান, কিন্তু অন্যভাবে, মানে আগের মতো। কিন্তু উপযাচক হয়ে তাঁর সঙ্গে বেশি কথা বলা কিংবা আগ্রহ দেখাবেন না। এতে ব্যক্তিত্বের ঝাঁজটা থাকে না, আর আপনার পতি-দেবতাও ভেবে নেবেন ঠিক-ই তো আছে, আমি-ই সঠিক!
তাঁকে এটা ভাবতে দেওয়া যাবে না। কলহ-বিবাদে তিনি যদি বাসাও ছেড়ে যান, যেতে দিন। আগের মতো প্রতিদিন নিয়ম করে ফোন করার দরকার নেই। ফেসবুক, টুইটার এমনকি, মেইলেও তাঁকে এড়িয়ে চলুন।
শুধু যখন তাঁর ভীষণ প্রয়োজন, তখন সাড়া দিন। পাশে দাঁড়ান। তাঁর জন্য যথাসাধ্য করুন। মানুষ এতে পাল্টায়, কথায়-কথায় কান্নায় নয়।
মাসব্যাপী এমন আচরণ ধরে রাখতে পারলে সেটা হবে নিজের প্রতি আপনার নিজেরই এক ধরনের উপহার। এই নিঃশব্দ অভিমানী সময়ে ভাবুন, আপনি সত্যিই আপনার স্বামীকে ফিরে পেতে চান কি না? মনের ভেতর থেকে ইতিবাচক জবাব পেলে আবার ভাবুন। কারণ, দাম্পত্য জীবন চাকরি নয় যে এখন ভাল্লাগচ্ছে তো তখন লাগছে না।
যদি সত্যি তাঁকে ফিরে পেতে চান কিংবা ভালোবাসেন, তাহলে সবার আগে সংশোধন করুন নিজেকে। পুনর্বিন্যাস করুন নিজের স্বভাব-আচরণ।
যেসব ব্যাপারে সম্পর্কে ফাটল ধরেছে, সেসব ব্যাপারে নিজের ভূমিকাটা ভেবে দেখুন। বদমেজাজি স্বভাব থাকলে সেটা পাল্টাতে হবে। ঝেঁটে ফেলতে হবে আলসেমি কিংবা কপট মনোভাব। কিন্তু স্বাভাবিক জীবন ধরে রাখুন। চাকরি কিংবা পড়ালেখা করুন, মানুষের সঙ্গে প্রাণখুলে মিশুন। আড্ডা দিন। বাংলাদেশের সমাজে এসব হয়তো সেভাবে কেউ মেনে নেবে না।
স্বামীর সঙ্গে কলহ থাকাকালে বউদের আবার কিসের আড্ডা! কিন্তু এটাও তো সত্য, সমাজের কেউ-ই স্বপ্রণোদিত হয়ে আপনার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে না। যা করার নিজেকেই করতে হবে।
বিচ্ছেদকালীন এই সময়ে বহির্জগতের স্বাভাবিক জীবন আপনাকে ঢেলে সাজাবে। ওদিকে অভিমানী স্বামীও হয়তো আপনার এড়িয়ে চলায় নিজের ভুল বুঝতে পারবেন। এটা সত্য যে কোনো মানুষই এড়িয়ে চলা সহ্য করতে পারে না। নিজের বউ হলে তো কথা-ই নেই! স্বামীর এই নমনীয় মানসিক পরিস্থিতিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করুন।
খোলা মনে কথা বলে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করুন। এ সময় কথা বলার সময় তিনি নিজেও কিন্তু আপনার পরিবর্তন ধরতে পারবেন। যদি সত্যিই তিনি আপনাকে ভালোবেসে থাকেন, তাহলে একটা সিদ্ধান্ত আসবেই। ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা, আপনি যে তাঁকে ভালোবাসেন, সেই প্রমাণ হলো আপনার ফিরে আসা।
কিন্তু স্বামী যদি তা না চান? তাহলে ওই যে মাসব্যাপী এড়িয়ে চলে স্বাভাবিক জীবন বজায় রাখার চেষ্টা—সেই সময়টা আপনাকে তখন আর এতটা কষ্ট পেতে দেবে না, যতটা পাওয়ার কথা ছিল।