করোনা মহামারীতে এখন সারা বিশ্ব একধরনের বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর বিস্তার চীনের উহান শহর থেকে শুরু হলেও এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় দুই শতাধিক দেশে। মোট আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২২ লাখ মানুষ এবং মৃতের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। গত দুইদিনে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই মৃত্যু বরণ করেছে সারে ৭ হাজার মানুষ। পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশে আজকে পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২১৪৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা ৮৪ জন। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। মহামারীর আশংকায় মানুষ যেমন আতঙ্কিত ঠিক তেমনি জীবন-জীবিকার ব্যপারেও শঙ্কিত। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন সহসাই হয়তো অর্থনীতি আবার সচল হয়ে উঠবেনা। উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের জীবনমান স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে। ঘরভাড়া, ইউটিলিটি বিল পরিশোধের পাশাপাশি লকডাউন চলাকালে বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা দিচ্ছে তারা। অর্থনৈতিক কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে আড়াই কোটির বেশি মানুষ। নিম্নবিত্ত মানুষের সংখ্যা মিলে এর অংকটা হয়তো দাঁড়াবে চার-পাচ কোটির উপরে। যাদের জীবন যাপন এখনই সংকটের মধ্যে পড়েছে। পরবর্তী অবস্থা কি দাড়াতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
এবার আসা যাক মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিষয়ে। বলা হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণিই হচ্ছে সমাজের ভারসাম্য। একটি দেশের উন্নয়নের সূচক খুব সহজেই নির্ধারণ করা যায় যে কত মানুষ সে দেশে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উন্নিত হয়েছে। বাংলাদেশে চলমান এই সংকটে সবচাইতে বেশি পরিস্থিতির স্বীকার হবে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় পঁচিশ ভাগ মানুষই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আর এই মানুষগুলোই হচ্ছে দেশের মূল চালিকাশক্তি। দেশে মোট ক্ষুদ্র ও মাঝারি (এসএমই) উদ্যোক্তার সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ এবং ক্ষুদ্র শিল্প কারখানার সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার যা দেশের মোট শিল্প কারখানার ৬০% বেশি।
আর এই সকল ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবসায়ীক একটি অন্যতম মৌসুম হচ্ছে রমজান মাস। ঈদ এবং রমজানকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা সারা বছর বিভিন্ন কর্মতৎপরতা চালিয়ে থাকে, বিনিয়োগ করে নিজের সর্বোচ্চটুকু। আর এই বিনিয়োগের যোগান আসে নিজের সামর্থ্যের বাহিরেও ব্যক্তিগত ঋণ ও ব্যাংক ঋণ হতে। আশা একটাই রমজান আসলে লাভ সহ ফিরে আসবে মূলধন। কাচামালের পাইকাররাও বাকিতে মালামাল সরবরাহ করে এসব উদ্যোক্তাদের রমজানে বাকী ফেরত পাবে এই আশায়। এক কথায় কমবেশি প্রায় সকল ব্যবসায়ীরাই এই বিনিয়োগের জোগান দিয়ে থাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। কিন্তু এবারের রমজানে ব্যবসার সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়েছে করোনা ভাইরাস মহামারি! বিশ্বের বহুদেশের মতো বাংলাদেশও এখন চলছে লকডাউন। জীবন বাঁচাতে এই লকডাউনের কোন বিকল্পও নেই। তাই বাঁচার তাগিদেই সবাইকে থাকতে হবে ঘরবন্দী। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য এভাবে কতোদিন থাকা যাবে ঘরে! জীবিকার সংগ্রাম না করলে কি পরিবার নিয়ে টিকে থাকা যাবে? সারা বছরের বিনিয়োগেরই বা কি হবে? কিভাবেই বা পরিশোধ করবো ব্যাংক কিংবা ব্যক্তিগত অথবা মহাজনের ঋণ? মার্চ মাস পার করে এখন এপ্রিল শেষের দিকে। গচ্ছিত অর্থ শেষ হয় হয় প্রায়। সামনের সময়গুলো সংসার নিয়ে কিভাবে কাটাবে এমন চিন্তা-ভাবনায় ঘরবন্দী সময়ে হতাশা আর দুঃশ্চিতায় অনিশ্চিত সময় কাটাচ্ছে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। বড় শিল্প, রপ্তানিমূখী গার্মেন্টস এর জন্য সরকার ইতিমধ্যেই প্রণোদনা ঋণ ঘোষণা করেছে। কিন্তু দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠী তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পদ্যোক্তাদের জন্য কোন প্রণোদনা সহায়তা এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। এই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ পরিবার আর কয়েক কোটি শ্রমিক। তাদের কথা বিবেচনা করে এখনই করোনা পরবর্তী সময়ে তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য অর্থ সহায়তা ও ঋণ প্রণোদনার উদ্যোগ গ্রহন করা জরুরি। পাশাপাশি এই লকডাউন চলাকালে নিম্নবিত্ত মানুষের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য যথাযথ সাহায্য সহযোগিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কেননা “না পারি কইতে, না পারি সইতে” এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য আগ বাড়িয়েই সাহায্য নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে হয়তো অনেক পরিবার অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে মারা যাবে অনেকের অজান্তেই!
জাহিদ আবেদীন, ঢাকা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।