ডেস্ক নিউজ : ধানমন্ডির বাসিন্দা শফিকুল ইসলামের জ্বর আসার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নমুনা দেয়ার পর করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হন।
১৪ দিন পরে তিনি আবার নমুনা পরীক্ষা করানোর পর নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। আরো নিশ্চিত হতে সাত দিন পরে তিনি আরেকবার টেস্ট করার কথা ভাবছেন।
বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন যে ১৭ হাজার করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, ইসলামের মতো অনেকেই সেই তালিকায় একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন।
আবার কাঁঠাল বাগানের বাসিন্দা বেবি আক্তার জ্বর, কাশি হওয়ার পরেও কোনো টেস্ট করাননি। গৃহকর্মী বেবি আক্তার কয়েক দিন বাসায় শুয়ে থাকার পর শরীর একটু সুস্থ হতেই আবার কাজ করা শুরু করেছেন।
লক্ষণ থাকার পরও বেবি আক্তারের মতো অনেকেই করোনাভাইরাসের পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে প্রতিদিন করোনাভাইরাসের যে ১৭ হাজার পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে, তাতে প্রকৃত আক্রান্তদের চিত্র কতটা ফুটে উঠছে?
করোনাভাইরাস টেস্টে কার কত ভাগ?
বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সোমবার জানানো হয়, আগের ২৪ ঘণ্টায় মোট নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৪১৩টি, তবে আগে সংগ্রহ করা নমুনাসহ পরীক্ষা করা হয়েছে ১৭,৮৩৭টি। ২৯ জুন পর্যন্ত মোট পরীক্ষা করা হয়েছে সাত লাখ ৪৮ হাজার ৪৩টি। দেশে সব মিলিয়ে কোভিড-১৯ রোগী মোট শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ ৪১ হাজার ৮০১ জন।
কিন্তু প্রতিদিনের সংগ্রহ করা নমুনার মধ্যে যেমন একেবারে নতুন সম্ভাব্য রোগী রয়েছে, তেমনি পুরনো শনাক্ত হওয়া রোগীরাও রয়েছেন, যারা করোনাভাইরাস মুক্ত হয়েছেন কিনা, সেটা পরীক্ষা করতে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার পরীক্ষা করছেন।
এই নমুনার মধ্যে রয়েছে সাধারণ ব্যক্তির বাইরেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের সদস্য, চিকিৎসক-নার্স, সাংবাদিকসহ অনেকে, যাদের অনেকে নিয়মিতভাবে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করিয়ে থাকেন।
পুলিশ ও চিকিৎসকদের কয়েকজন জানিয়েছেন, লক্ষণ দেখা দিলেই তাদের টেস্টের জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদের টেস্টের ব্যবস্থাও করা হয়।
যদিও মোট নমুনা পরীক্ষার মধ্যে পেশাজীবীদের ভাগ কত, সেরকম কোন তথ্য নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সময় শ্রেণী-পেশার কতজন মানুষের পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেরকম কোন তথ্য নেই তাদের কাছে।
”পরীক্ষা হওয়া রোগীদের বেশিরভাগই নতুন। পেশা হিসাবে বা শ্রেণী হিসাবে এখনো ওইভাবে তথ্য নেই। হয়তো পরে যখন এগুলো নিয়ে গবেষণা হবে, তখন এসব দেখা হবে।” তিনি বলছেন।
তবে বেশ কয়েকটি জেলার সিভিল সার্জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেসব জেলায় প্রতিদিন যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়, তার মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের নমুনা থাকে গড়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ।
এই চাকরিজীবীদের মধ্যে রয়েছে পুলিশ, প্রশাসনের সদস্য, চিকিৎসক-হাসপাতাল কর্মী ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ঢাকায় রাজারবাগে প্রতিদিন ৩৫০ জন পুলিশ সদস্যের নমুনা পরীক্ষা করা হয়।
প্রশাসনের সদস্যদের জন্য ঢাকার অফিসারস ক্লাবে পরীক্ষা হয়, যেখানে গড়ে প্রতিদিন ১০০র মতো পরীক্ষা হয়।
সাংবাদিকদের দুইটি ক্লাবের মাধ্যমে একদিন পরপর পরীক্ষা হয়, সেখানে ৩০ জনের নমুনা পরীক্ষা হয়।
এর বাইরে জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছেন, যারা বিশেষ সুবিধায় পরীক্ষা করিয়ে থাকেন।
একজন সিভিল সার্জন বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রথমদিকে বিশেষ প্রভাব বা তদবির করে টেস্ট করানোর প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। তবে সম্প্রতি এটা কিছুটা কমেছে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সেখানে ভর্তি রোগী ছাড়াও যে কেউ ইচ্ছা করলেই নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে পরীক্ষা করাতে পারেন।
সেই পরীক্ষার হিসাবও সরকারি দৈনিক তথ্য বিবরণীতে যোগ হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলছেন, ”বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী পেশার মানুষ টেস্টে কতোটা সুবিধা পাচ্ছেন, সেটা সুনির্দিষ্ট বলা মুশকিল। তবে সাধারণ মানুষ টেস্টের ক্ষেত্রে যে স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার কথা সেটা পাচ্ছেন না।”
তিনি বলছেন, ”আমাদের ব্যবস্থাপনা এমন হওয়া উচিত, যারই পরীক্ষার প্রয়োজন, তিনি যেন এটা সহজে করাতে পারেন। সেটা তিনি যেই শ্রেণী পেশার মানুষ হোক না কেন। কিন্তু সেই জায়গাটায় সমস্যা রয়েছে।”
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এসএম আলমগীর বলছেন, ”সাধারণ মানুষও পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। তবে কেউ কেউ বাড়তি সুবিধা নেয়ার কারণে অন্যদের সুযোগ সংকুচিত করে দিচ্ছে।”
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি এবং জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলছেন, ”চাহিদার তুলনায় এখনো আমাদের টেস্টের সংখ্যা কিন্তু কম।
সেটা বাড়ানোর জন্য আমরা পরামর্শ দিয়েছি, যাতে আরটিপিসিআরের পাশাপাশি র্যাপিড অ্যান্টিজেনের মতো পরীক্ষাও চালু করা হয়। সেটা এর মধ্যেই দুইটি জায়গায় শুরু হয়েছে, আরো বাড়ানো হবে।”
”যতজন পরীক্ষা করাতে চাইবেন, সবাই যেন করাতে পারেন। কেউ যেন ফেরত না যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সেটা সব পেশাজীবীর, সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে।” তিনি বলছেন।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলছেন, চিকিৎসকদের অনেককে টেস্টের জন্য ছোটাছুটি করতে হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তাহলে অন্য পেশাজীবী বা অন্য শ্রেণীগোষ্ঠীর মানুষের যে অসুবিধা হচ্ছে, সেটা বোঝা যায়।
বে-নজির আহমেদ পরামর্শ দিচ্ছেন, যাদের করোনাভাইরাসের পরীক্ষা দরকার, তাদের সবার টেস্ট করা হবে, এমন একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি, যাদেরই পরীক্ষার দরকার হবে, তাদের নমুনা সংগ্রহের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে।
২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে, যাদের পজিটিভ হবে, তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এটা করা গেলে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি হবে।
পরীক্ষায় প্রকৃত করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিত্র কতোটা বেরিয়ে আসছে?
প্রতিদিন বাংলাদেশে যে ১৭ হাজারের মতো পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
কারণ এই মোট পরীক্ষা করে যে রোগী শনাক্তের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে যেমন নতুন রোগী রয়েছে, তেমনি আগে যারা আক্রান্ত হয়ে এখনো সুস্থ হননি, পুনরায় পজিটিভ হয়েছে, সেই সংখ্যাও রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলছেন, ”যেভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্টিং হচ্ছে, সেটা ঠিক হচ্ছে না।
আসলে পরীক্ষার রিপোটিং এই ভাবে হওয়া উচিত ছিল যে, প্রথমে জানা উচিত ছিল গত ২৪ ঘণ্টায় কতজন সম্ভাব্য করোনা রোগীর তথ্য পাওয়া গেল। তাহলে জানা যেত, আসলে কতজন নতুন করোনাভাইরাস রোগী পাওয়া গেল।”
তিনি বলেছেন, ”দ্বিতীয়ত গত ২৪ ঘণ্টায় যে পরীক্ষা করা হয়েছে, তার মধ্যে কতজন পজিটিভ হয়েছে? যেসব পরীক্ষা করা হয়েছে, তার মধ্যে কতজন নতুন রোগী, কতজন আক্রান্তদের পুনরায় পরীক্ষা করা হয়েছে, কতজন সুস্থ হয়েছে, এভাবে ভাগ করা গেলে আসল চিত্রটা পাওয়া যেতো।”
বে-নজির আহমেদ বলছেন ”আসলে এখন যেভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে, এটা খুবই ক্রুটিপূর্ণ একটা রিপোটিং।”
তবে স্বাস্থ্য বিভাগে দেয়া নতুন গাইডলাইনে আইইডিসিআরের গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষায় পজিটিভ হওয়ার ১৪দিন পর যদি সুস্থ হয়ে যান, আর লক্ষণ না থাকে, তাহলে দ্বিতীয় দফার পরীক্ষার আর দরকার হবে না।
বরং তাকে পরীক্ষা ছাড়াই সুস্থ বলে ধরে নেয়া হবে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা: মুশতাক হোসেন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “যেসব দেশের সক্ষমতা আছে তারা দুটি টেস্ট করাতে পারে কিন্তু আমরা যে খসড়া তৈরি করেছি, তাতে ১৪ দিনের কথা বলা হয়েছে। এর পর সুস্থ হওয়া ব্যক্তিকে নেগেটিভ হিসেবে গণনা করা হবে,”।
স্বাস্থ্য বিভাগের একটি সূত্রও এটি নিশ্চিত করেছে যে বাংলাদেশে এখন কোনো ব্যক্তি পজিটিভ হলে চিকিৎসা নেয়ার পর দুটি আরটিপিসিআর পরীক্ষায় যে নেগেটিভ ফল আসতে হতো, সেটি আগামীতে আর করা হবে না।
তবে বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়নি।
টেস্টের মূল্য নির্ধারণ কতোটা কাজে আসবে?
বাংলাদেশে গত ২১ জানুয়ারি থেকে বিনামূল্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হলেও গত রোববার পরীক্ষায় একটি মূল্য ধার্য করেছে সরকার।
এখন থেকে সরকারিভাবে হাসপাতালে ভর্তি রোগী বা বুথে নমুনা দেয়ার ক্ষেত্রে ২০০ টাকা করে দিতে হবে।
আর বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলে ৫০০ টাকা দিতে হবে।
এর আগে থেকেই বেসরকারি হাসপাতালে টেস্ট করাতে ৩৫০০ টাকা থেকে ৫৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি এবং জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলছেন, ”টেস্টের টোটাল খরচ সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।
সেটা অনেক সময় অপব্যবহার করা হচ্ছে। তখন দেখা যায়, যার দরকার, সে করাতে পারছে না, অথচ একজন অনেকের টেস্ট করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই মূল্য চার্জ করার কারণে সেটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
”আমি মনে করি না, এই ফি ধার্য করার কারণে কোনো সমস্যা হবে না। যে করাচ্ছে তার মধ্যে যেমন একটা ওনারশিপ আসবে, তেমনি অযথা টেস্ট করানোর প্রবণতা কমবে।” তিনি বলছেন।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলছেন, “কারা অপ্রয়োজনে টেস্ট করেন? বড় লোক বা প্রভাব আছে এমন ব্যক্তিরা। তাদের জন্য একাধিক টেস্টে এই সামান্য ফি নিরুৎসাহিত করবে না।”
”কিন্তু এর ফলে যারা প্রান্তিক লোক, তাদের সেবা পাওয়ার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেবে। অনেক দরিদ্র বা প্রান্তিক লোক এই ফি দেয়ার কথা চিন্তা করে লক্ষণ থাকলেও টেস্ট করাবেন না, ফলে তারা শনাক্ত হবেন না।”
তিনি মনে করেন, এটা একদিকে যেমন টেস্টের সংখ্যা কমাবে না, আবার এই অর্থ থেকে দেশ বা রাষ্ট্র তেমন কিছু লাভও করবে না।
বরং এটি অনেক প্রান্তিক বা দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করে তুলতে পারে।
সূত্র : বিবিসি