ডেস্ক নিউজ : জালিয়াতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন স্বাস্থ্য খাতের ১৯ ঠিকাদার। স্বাস্থ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে গত পাঁচ বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই সিন্ডিকেট। বাজারমূল্যের চেয়ে মেডিক্যাল যন্ত্রপাতির দাম ১৫০ থেকে ২০০ গুণ বেশি দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছে তারা। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ঘুরেফিরে এই ঠিকাদাররাই বেশির ভাগ কাজ পেয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতের যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র কেনার নামে জালিয়াতি করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্লট, বাড়ি, গাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাঁরা। শুধু দেশেই নয়, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে এই সিন্ডিকেট। জালিয়াতি করে ঠিকাদারদের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতালের কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকার তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। স্বাস্থ্য খাতের এই দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে দুদক এরই মধ্যে ১১টি মামলা করেছে। দুর্নীতির অভিযোগে ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশনাসহ সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। ওই সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ১৪ ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের ডন হিসেবে পরিচিত টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু ও জেএমআইয়ের মালিক আব্দুর রাজ্জাকসহ পাঁচ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের তলবও করা হয়েছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাঁদের জালিয়াতি ও দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্র জানায়।
স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কথা উঠলেই সবার আগে আসে আলোচিত ঠিকাদার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী রুবিনা আক্তারের নাম। নামে-বেনামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্নীতি এবং নিম্নমানের জিনিসপত্র সরবরাহ করে হাতিয়ে নিয়েছেন তাঁরা প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। অনুসন্ধান শেষে ৩১৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক তিনটি মামলা করেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। মামলার পর তদন্ত করছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মো. তৌফিকুল ইসলাম। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে আবজাল-রুবিনা দম্পতির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আবজাল-রুবিনা বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছেন।
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ঠিকাদার আবজাল দম্পতির দুর্নীতির কথা সবাই জানলেও আরেক দুর্নীতিবাজ বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেনের কথা কেউ জানে না। মুন্সী সাজ্জাদ হোসেনের আত্মীয়-স্বজনের নামে রয়েছে পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে বাজারমূল্যের চেয়ে ১৫০ থেকে ২০০ গুণ বেশি দামে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে মুন্সী সাজ্জাদ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় শতকোটি টাকা। আবজাল দম্পতি এবং মুন্সী সাজ্জাদের চেয়ে আরেকটু এগিয়ে ঠিকাদার জাহের উদ্দিন সরকারের দুর্নীতি। তাঁর নিজ নামে এবং আত্মীয়-স্বজনের নামে রয়েছে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক, মার্কেন্টাইল ট্রেড ও ইউনিভার্সেল ট্রেড নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে জাহের উদ্দিন প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
অনুসন্ধানে নেমে দুদক দুর্নীতির এসব চিত্র খুঁজে পায়। দুর্নীতি ও অনিয়ম করে অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দুদক কালো তালিকাভুক্ত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠানোর ছয় মাস পর সম্প্রতি এই ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মালিক ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল মিঠু এবং করোনাকালে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে নিম্নমানের পিপিই, মাস্কসহ চিকিৎসা সুরক্ষা সামগ্রী পাঠানো জেএমআই কম্পানির মালিক আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে এখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি।
তবে কালো তালিকাভুক্তির বাইরে থাকা মিঠু, আব্দুর রাজ্জাকসহ পাঁচ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে কয়েক শ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজসহ স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ করে সরকারের প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এসব দুর্নীতির সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এরই মধ্যে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগে দুদক থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে পাঁচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের। মেসার্স জেএমআই হসপিটাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রাজ্জাক, এলান করপোরেশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম আমিন, মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেডের পরিচালক মো. হুমায়ুন কবির এবং ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান ও লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্র্যাট লিমিটেডের মালিক মো. মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে তলব করা হয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানদলের প্রধান দুদক পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর সই করা চিঠিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঠিদাকার মো. আব্দুর রাজ্জাক ও আমিনুল ইসলাম আমিনকে আগামী ৮ জুলাই এবং মো. হুমায়ুন কবির ও মো. মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে আগামী ৯ জুলাই সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, কালো তালিকাভুক্ত এবং দুদক যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে, এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি কিনেছে চাহিদাপত্র ছাড়াই। ‘এ’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতির মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে ‘সি’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতি। কখনো কখনো দেশে থেকেই যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কোনো নামকরা বিদেশি কম্পানির নামে। ফরিদপুর মেডিক্যালে যন্ত্রপাতির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ১৮৬ গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। ১৭৫ কোটি টাকার নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য। শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যালে আড়াই শ কোটি টাকা, রংপুর মেডিক্যাল কলেজে ভারী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকার পরও চার কোটি টাকার সার্জিক্যাল ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এ ছাড়া হাসপাতালটির বিরুদ্ধে আরো ২০ কোটি টাকা গরমিলের অভিযোগ রয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চাহিদাপত্র ছাড়াই ভুয়া বিল দাখিল করে পিএসিএস সফটওয়্যার সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির নামে ছয় কোটি ছয় লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়। সাতক্ষীরা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে প্রায় ৩০ কোটি টাকা, নোয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৫ কোটি টাকা, নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যার হাসপাতালে ১৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ২১ কোটি ৭০ লাখ টাকা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে ৬৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ২৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা, মৌলভীবাজার আড়াই শ শয্যার হাসপাতালের জন্য ১৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও তা অব্যবহৃত রয়েছে। কক্সবাজার মেডিক্যালে ভুয়া যন্ত্রপাতির লেবেল লাগিয়ে সাড়ে ৪৮ কোটি টাকার মধ্যে ৩৭ কোটি টাকাই আত্মসাৎ করা হয়।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কমিশন শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ২০১৭ সালেই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক দল গঠন করা হয়। ২০১৯ সালের শুরুতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির (১১টি) উৎস ও তা নিয়ন্ত্রণে ২৫ দফা সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। দুদকের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা গেলে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির লাগাম কিছুটা টেনে ধরা সম্ভব হতো। এ ছাড়া ঢাকা, সাতক্ষীরা, রংপুর, চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে কমিশন থেকে ১১টি মামলা করা হয়। এই ১১টি মামলায় সম্পৃক্ত ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করা হবে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কমিশন জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে।’ কালো তালিকাভুক্ত ১৪ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স অনিক ট্রেডার্স, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন অ্যান্ড মেসার্স এসকে ট্রেডার্স, এমএইচ ফার্মা, মেসার্স অভি ড্রাগস, মেসার্স আলবিরা ফার্মেসি, এসএম ট্রেডার্স, মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিক্যাল কম্পানি, ইউনিভার্সেল ট্রেড করপোরেশন, এএসএল, বেয়ার এভিয়েশন।