ডেস্ক নিউজ : বিকশিত হয়ে বিস্তৃত হতে চাওয়া মানব মনের মৌল বৈশিষ্ট্য। এই ‘বিস্তার’ আদতে মানুষের মনের বিস্তারকে (এক্সপ্যানশন) বোঝায়। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন বিস্তারই জীবন—‘এক্সপ্যানশন ইজ লাইফ’। মারণ ভাইরাস কভিড-১৯ সেই বিস্তার সূত্র মেনে মানবসমাজের সমাধি রচনা করতে চাইছে। জিনের গঠন বদলে প্রতিনিয়ত এই ভাইরাস যেমন নিজের চরিত্রই বদলে ফেলছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে। প্রতিদিন মৃত্যু তিন হাজার ছুঁই ছুঁই ছিল আমেরিকায়, ইতালি—স্পেনে হাজার করে। মৃত্যুরেখা আকাশ ছুঁতে চাইছে আর ‘ফ্লাটেনিং দি কার্ভ’ রাখতে চিকিৎসাকর্মীদের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। অযুত মৃত্যুর বিপরীতে নতুন মৃত্যু ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা অপরিমেয় মানসিক চাপ নিয়ে ওষুধ আবিষ্কারে ব্যস্ত। অদেখা আণুবীক্ষণিক শত্রুর বিরুদ্ধে এক স্নায়ুক্ষয়ী মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে লিপ্ত আবিশ্ব।
একালের যুদ্ধে কনভেনশনাল আর্মরির সঙ্গে সাইকোলজিক্যাল ওয়েপন যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। শত্রুর মোকাবেলায় সব পক্ষই চায় একে অপরকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে যুদ্ধে জয়লাভ করতে। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে নিজেদের ইতিবাচক চিন্তাধারা সফলভাবে জারি রেখে শত্রুপক্ষের চিন্তা-পরিকল্পনা, প্রবণতা ও আচরণকে প্রভাবিত করার কৌশল প্রয়োগ করা হয়। এখন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সমগ্র মানবজাতি সর্বাত্মক যুদ্ধে ব্যস্ত। এখানে প্রতিপক্ষ কোনো মানুষ বা সেনাবাহিনী নয়, তবে ভাইরাসটিও এরই মধ্যে কয়েকবার সিকোয়েন্সিং পাল্টে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর। এতে প্রপাগান্ডা ভিত্তিক যুদ্ধ হয়তো নেই কিন্তু ক্রমবিবর্তনশীল ভাইরাসটির বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার মতো সর্বজনীন ওষুধ আবিষ্কারের যুদ্ধে বিজ্ঞানীরা।
করোনাভাইরাসজনিত মহামারিতে বহু মানুষ অসুস্থ হয়েছে, মৃত্যু ঘটেছে। অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক মন্দা সমাজে কত গভীর ক্ষত তৈরি করবে, কত মানুষ কর্মহীন, খাদ্যহীন হবে কে জানে? এমন ভীতিপূর্ণ মারণকাল পার করেনি মানুষ। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হতে হবে নিশ্চিত। ইউরোপ-আমেরিকার সুপারশপগুলোর পণ্যশূন্য র্যাক আর এশিয়ার কিছু দেশে মৃত্যুর সত্কারে বাধাদান—সবই মানবতার অপমান, যেন বা আমাদের শূন্যগর্ভ সব বিশ্বাসের ফলিত রূপায়ণ। কিন্তু তার পরও ন্যূনতম সুরক্ষা না নিয়ে রোগী বাঁচাতে নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন কত ডাক্তার-সেবিকা। তরুণরা ঝুঁকি নিয়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছে ত্রাণ নিয়ে, তখন মনে হয় আশ্বস্ত হওয়ার কিছু এখনো আছে। নেওয়া যায় ডিকেন্সিয়ান আশ্রয়, সে ছিল একই সঙ্গে সর্বোত্কৃষ্ট এবং সর্বাধিক অপকৃষ্ট একসময়।
ভয়াবহ মহামারির পূর্বাভাস জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা আগেই দিয়েছিলেন, আমরা কান দিইনি। বায়বীয় সতর্কতাকে আমলে না নেওয়ার জেরে ভাইরাস মৃত্যু পরোয়ানার পত্তনি নিয়ে প্রাণ সংহার করে চলেছে। সম্পদশালী প্রযুক্তির উত্কর্ষ অর্জনকারী দেশগুলোর সব বিচ্ছিন্ন হয়ে মানসিকভাবে নড়বড়ে হতে শুরু করেছে।
মহামারির ইতিহাসের সঙ্গে সংশয়গ্রস্ত গণমনস্তত্ত্ব (মাস সাইকোলজি) পাশাপাশি চলে। এই নাজুক সময়ে গণমানস চরমভাবে অস্থির ও দ্বিধান্বিত থাকে। বিভ্রান্তির সময়ে মানুষের সামনে পাওয়া যেকোনো তথ্যকেই সত্য বলে পরিত্রাণের উপায় খোঁঁজে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ভারতে গোমূত্র পানে নিরাময়ের মতো সংবাদপত্র বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। আমাদের দেশে থানকুনি পাতা খেতে দেখা গেছে অনেক জেলায়। বিপর্যস্ত মন নিয়ে মানসিক সুস্থিতির পরিচয় দেওয়া যায় না, আশকোনা হজ ক্যাম্পে ইতালিফেরত যুবকের আচরণ আর তাঁর জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘নবাবজাদা’ উচ্চারণ তার প্রমাণ। আর করোনা সংক্রমণ শনাক্তকরণের শিথিলতায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, তাঁরা কি চান—সংখ্যাটা বেশি হোক? এমন রূঢ়তায় চটজলদি সাংবাদিক থামানো হয়তো গেল কিন্তু আচরণ যথাযথ কী হলো?
গণ-হিস্টিরিয়া ছড়ানোর জন্য দুটি বিষয়ের উপস্থিতি একসঙ্গে থাকে। প্রথমত, যে ঘটনা বা বিষয়কে কেন্দ্র করে গণ-হিস্টিরিয়া প্রসারিত হবে, সেই ঘটনা জনগুরুত্বপূর্ণ হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওই বিষয় সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে যথাযথ ধারণা ও পর্যাপ্ত তথ্য সরবারহের ঘাটতি থাকবে। সর্বশক্তি ও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের কাজ হবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আর জনগণের কাছে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া।
করোনার বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে মানুষের অভূতপূর্ব সারা দেখে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নোবেলজয়ী বায়োফিজিসিস্ট মাইকেল লেভিট ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, ভাইরাস দ্রুতই নিশ্চিহ্ন হবে। ওরাকলের ভবিষ্যদ্বাণীর মতো শোনায় যদিও, এই অকালে অনেকেই বিশ্বাস রাখতে চাইবেন না, তবে তাঁর এর আগের পূর্বানুমান (অবশ্যই বিজ্ঞান ও তথ্যভিত্তিক) মনে করলে আস্থা পাওয়া যায়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিজুড়ে চীনে যখন কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, তখন তিনি বলেছিলেন, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার হার আগামী সপ্তাহ থেকে কমবে। তাঁর পূর্বাভাস সত্য হয়েছে।
মহামারি একই সঙ্গে প্রাণঘাতী ও মর্মঘাতী। এর প্রভাবে সামষ্টিক বিষাদে আক্রান্ত মানব মানস। তার পরও এই ভাইরাস মোকাবেলায় চীন সফল হয়েছে, যা অন্য দেশগুলোর জন্য উদাহরণ হতে পারে। চীনের ছিল হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের দল। চীনা সরকার ‘গণযুদ্ধ’ ঘোষণা দিয়ে ‘ফাইট অন উহান, ফাইট অন চায়না’ কর্মসূচি চালু করে। ভাইরাস মোকাবেলার যুদ্ধে চীনের দেখানো পথ আমাদের অনুকরণীয় হতে পারে। আর উত্সাহ পেতে পারি প্রায় ৪০০ বছর আগে এমন এক মহামারির কালে অবরুদ্ধ অবস্থায় শেকসপিয়ারের কিং লিয়ারের বচন—মেন মাস্ট এনডিউর ।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট