ডেস্ক নিউজ : অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিবছর বাংলাদেশের যে বাণিজ্য (আমদানি-রফতানি) হচ্ছে, এর ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ অর্থই বিদেশে পাচার হচ্ছে-যা মোট পাচারের ৮০ শতাংশ। ওভার ইনভয়েসিং (আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো) এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের (রফতানিতে মূল্য কম দেখানো) মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার হয়। পাচার হওয়া টাকার সিংহভাগই যায় উন্নত ৩৬ দেশে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারকে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে।
এর পরপরই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য প্রণয়ন করা হয় বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে একটি গাইডলাইন। এটি কার্যকর অর্থে বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সম্প্রতি কঠোর নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত এসেছে। এই অবস্থার উত্তরণে পাচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সম্প্রতি কুয়েতে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুলের পাচার করা অর্থ জব্দ হওয়ায় নড়েচড়ে বসেছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এর পরপরই ৯ আগস্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসানসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আসাদুল ইসলাম বলেছেন, দেশ থেকে টাকা পাচারের কারণে অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হচ্ছে। যে কোনো উপায়ে দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে হবে। কেননা অর্থ পাচার হয়ে গেলে ফেরত আনা কঠিন। পাচার করা অর্থ ফেরত পাঠাতে উন্নত দেশগুলোর ভূমিকা স্বচ্ছ নয়। তাদের আগ্রহ ও অঙ্গীকারের মধ্যে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। ওই বৈঠকে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, টাকা পাচার বন্ধ করতে ব্যাংকগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইনগুলো তারা বাস্তবায়নে আরও বেশি জোর দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এমডি মো. আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন বাতিল করায় মানি লন্ডারিং বেড়েছে। এটি পুনর্বহাল করা উচিত। কোনো সেন্ট্রাল ডাটাবেজ করে বিএফআইইউ ব্যাংকারদের সহায়তা করতে পারে কি না, বিষয়টি ভাবা দরকার। এছাড়া বিএফআইইউ-এর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান ওই বৈঠকে বলেন, বিএফআইইউ, দুদক, সিআইডির যৌথ উদ্যোগে ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন ঝুঁকি নিরূপণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং ও বেদেশে অর্থ পাচারকে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে বিএফআইইউ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ গঠন করে গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়। এটাই দাক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ গাইডলাইন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত আমদানি-রফতানির আড়ালেই অর্থ পাচার হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে আমরাও কয়েকটি ঘটনা চিহ্নিত করেছি। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তথ্য দিয়েছি। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। তার মতে, সারা পৃথিবীতে বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ বিষয়ে এখন সবাই সতর্ক। আমরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। তিনি বলেন, আমরা যে গাইডলাইন তৈরি করেছি, এটি মাত্র পাঁচটি দেশের আছে। এই গাইডলাইন মেনে চললে পাচার কমে আসবে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, করোনায় অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লেগেছে। এই অবস্থার উত্তরণে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধসহ আর্থিক খাতের অপরাধ যাতে বন্ধ হয়, সেই পদক্ষেপ জরুরি। তিনি বলেন, শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। কেননা আগে যেভাবে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে ওইভাবে শিল্পায়ন হয়নি। তিনি বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে টাকা পাচার বন্ধে ব্যাংকগুলোকে প্রচলিত নীতিমালা মেনে চলতে হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। আর পণ্যের মূল্যের ব্যাপারে আলাদা একটি ডাটাবেজ গড়ে তোলা হলে এক্ষেত্রে অনেক সহায়ক হবে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ব্যাপারে এ পর্যন্ত ৬টি উৎস থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি, সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রের অনুসন্ধানী সাংবাদিক সংগঠন পানামা ও প্যারাডাইস পেপার এবং মালয়েশিয়ার সরকারের প্রকাশিত সেকেন্ড হোমের তথ্য।
এসব সংস্থার তথ্যেই বাণিজ্যের আড়ালে তথ্য পাচারের কথা বলছে। সূত্র জানায়, কারোনাকালেও এ ধরনের পাচার বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের বিভিন্ন ধারা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করছে না। যে কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচার হচ্ছে। মানি লন্ডারিং আইনের কেওয়াইসি বা ‘গ্রাহককে জান’ সঠিকভাবে পালন করলে ব্যাংকগুলোয় বেনামি হিসাব থাকতে পারে না। আর বেআইনি হিসাব না থাকলে টাকা পাচার কমে যাবে। দেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে যেসব টাকা পাচার হচ্ছে, এর বড় অংশই যাচ্ছে বেনামি হিসাবের মাধ্যমে। এ কারণে ওই বৈঠকে ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গ্রাহকের কেওয়াইসি কঠোরভাবে পালন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো শিথিলতা দেখালে জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেগুলো প্রয়োগ করবে বলেও বৈঠকে হুশিয়ার করে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, এর বড় অংশই হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং। এর মধ্যে আমদানি-রফতানিতেই বেশি পাচার হয়। এতে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। করোনাকালে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় সামনের দিনগুলোয় চাপের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ধরনের চাপ মোকাবেলায় অর্থ পাচার বন্ধে কঠোর অবস্থান নিতে জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। যা দেশের চলতি বছরের (২০১৯-২০২০ অর্থবছরের) জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ১৯ শতাংশই কোনো না কোনোভাবেই পাচার হয়ে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশে প্রতিবছর আমদানি বাণিজ্য হয় ৫ হাজার কোটি ডলারের। এর ১৯ শতাংশ হিসাবে পাচার হচ্ছে ৯৫০ কোটি ডলার। প্রতিবছর গড়ে রফতানি আয় হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার। এর ১৯ শতাংশ হিসাবে পাচার হচ্ছে ৬৬৫ কোটি ডলার। আমদানি ও রফতানির আড়ালে পাচার হচ্ছে ১ হাজার ৬১৫ কোটি ডলার। জিএফআই-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪টি প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি, অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা। সূত্র জানায়, আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে বা পণ্য দেশে না এনে টাকা পাচার করা হচ্ছে। আর রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে বা পণ্যমূল্য দেশে না এনে টাকা পাচার করা হচ্ছে।
গত কয়েক বছরে দেশ থেকে এভাবে টাকা পাচারের একাধিক ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছে। সূত্র আরও জানায়, করোনাভাইরোসের সংক্রমণ মোকাবেলার জন্য বিদেশ থেকে যেসব পণ্যসামগ্রী আমদানি করা হয়েছে, সেগুলোর আড়ালেও টাকা পাচারের ঘটনা রয়েছে। এর মধ্যে করোনা শনাক্তের কিট, মাস্ক, পিপিইসহ নানা উপকরণ আমদানি করা হয়েছে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এসব প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে তদন্ত করা হচ্ছে।
এসব পণ্যের বেশির ভাগ এলসিই সরকারি ব্যাংকগুলোয় খোলা হয়েছে। এলসির বিপরীতে ব্যাংকগুলোয় পর্যাপ্ত অর্থও জমা করা হয়নি। জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে এসব এলসি খোলা হয়েছিল। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাদিক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর মধ্যে একটি কনটেইনারে শিল্পের কাঁচামালের পরিবর্তে ইট, বালি ও সিমেন্টের গোলা পাওয়া গেছে। ব্যাংকাররা মনে করেন, শিল্পের যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য আমদানি-রফতানি পণ্যের মূল্য ব্যাংকগুলোর পক্ষে অনেক সময় সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আমদানি ও রফতানিকারকের তথ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে অর্থ পাচার হলে ব্যাংকের কিছু করার থাকে না। এজন্য ব্যাংকাররা পণ্যে আমদানি-রফতানি মূল্যের বিষয়ে আলাদা একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করতে পারবে।