আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চীনসহ আরো ১৪টি দেশ নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা তৈরির চুক্তি হচ্ছে আগামীকাল রোববার।
সিঙ্গাপুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের চলতি শীর্ষ বৈঠকের শেষ দিনে অর্থাৎ আগামীকাল ১৫ নভেম্বর এমন একটি বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষর হতে যাচ্ছে, যা বিশ্ব বাণিজ্যে মৌলিক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সংবাদ সংস্থা বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
আসিয়ান জোটের ১০টি দেশ ছাড়াও এই চুক্তিতে সাক্ষর করছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এই চুক্তিতে ভারতেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সস্তা চীনা পণ্য তাদের বাজার ছেয়ে যাবে ভয়ে গতবছর তারা আলোচনা থেকে বেরিয়ে যায়।
‘রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’ বা আরসিইপি নামের নতুন এই জোটের অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। ফলে এই চুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোর মধ্যে যে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও এশিয়ার নতুন এই বাণিজ্য অঞ্চলটির পরিধি বড় হবে।
ব্যবসায় বিষয়ক পরামর্শক সংস্থা আইএইচএস মারকিটের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ রাজিব বিশ্বাসকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, ‘এই অঞ্চলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উদারকরণে এই চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অগ্রগতি।’ কারণ অর্থনীতিবিদ রাজিব বিশ্বাসের মতে, ‘আরসিইপি বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অঞ্চলে পরিণত হবে।’
‘চীনা ক্যু’
২০১২ সালে প্রথম এই চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারপর আট বছরে ধরে চীনের প্রবল উৎসাহ ও উদ্যোগে এটি বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে।
তবে, মুক্ত বাণিজ্যের এই চুক্তিকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের পথে একটি ক্যু বা অভ্যুত্থান হিসেবে দেখা হচ্ছে বলে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছে থাইল্যান্ডের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক ব্যাংকক পোস্ট।
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক আলেকজান্ডার ক্যাপ্রিকে উদ্ধৃত ব্যাংকক পোস্ট বলেছে, ‘এই জোট চীনকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে মুক্ত বাণিজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পিছিয়েছে, সেই শূন্যতা দখল করছে চীন। ২০১৬ সালে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে টিপিপি নামের যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করেছিল, ট্রাম্প সেটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যান। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, নতুন চুক্তিটি হলে ভবিষ্যতে এশিয়ায় বাণিজ্যের নীতি ও শর্ত নিয়ন্ত্রণ করবে চীন।
গবেষণা সংস্থা কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ইভান ফেইগেনবমকে উদ্ধৃত করে ওয়াশিংটনের গবেষণাভিত্তিক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাট লিখেছে, ‘এশিয়ায় প্রধান দুই বাণিজ্য চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নেই। ফলে এশিয়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের শর্ত ও মান নির্ধারণের ক্ষমতার হাতবদল হবে, এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে সে অনুযায়ীই ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে।’
দ্য ডিপ্লোম্যাটের সাবেক সম্পাদক অঙ্কিত পাণ্ডা টুইট করেছেন, ‘আরসিইপি চুক্তি যে হচ্ছে তাতে ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট যে এশিয়ায় বড় ঘটনা ঘটছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তাতে সামিল হোক বা না হোক আরো এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’
কেন উৎসাহী আসিয়ান
জাপান ও অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও চীনা আধিপত্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ আরইসিপিতে যোগ দিতে পিছপা তো হচ্ছেই না বরঞ্চ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে এ নিয়ে উৎসাহ বাড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট ।
মালয়েশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী মোহামেদ আজমিন আলি বলেছেন, ‘আট বছর ধরে রক্ত, ঘাম আর চোখের পানি ঝরিয়ে (আগামীকাল) রোববার আরসিইপি সাক্ষরের জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত হয়েছি।’
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিণতিতে আসিয়ান জোটের দেশগুলো যে চরম অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই চুক্তিতে সাক্ষর করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। চীন বিশ্বের একমাত্র বড় কোনো দেশ, যার অর্থনীতিতে এখনো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
অল্প কিছুদিন আগে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ঘোষণা করেছেন, আগামী ১০ বছরে চীন ২২ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করবে। শি জিন পিং বলেন, ‘চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার এবং এই বাজার আরো বড় হবে।’ দিনে দিনে নিজেদের বাজার আরো উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চীনকে নিয়ে ওজর-আপত্তি-উদ্বেগ থাকলেও, চীনের এই বিশাল বাজারের অংশীদার হওয়ার জন্য এশিয়ার বহু দেশ উদগ্রীব।
আরসিইপিতে এমন কিছু দেশ রয়েছে, যাদের কারো কারো মধ্যে মধ্যে বৈরিতা যেভাবে দিন দিন বাড়ছে তাতে শেষ পর্যন্ত এটি কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে। যেমন, চীন ও জাপানের মধ্যে কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বৈরিতা বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে রেষারেষির পারদ দিন দিন চড়ছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল বলেছেন, আরসিইপি নিয়ে খুব বেশি উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু সিঙ্গাপুরে এশিয়ান ট্রেড সেন্টারের ডেবোরা এমস বলেন, ‘কাউকে পছন্দ না করলেও তার সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখা খুবই সম্ভব। আরসিইপি সেটাই করছে। মতভেদ থাকলেও, বাণিজ্যের সম্পর্ক থেকে সেগুলোকে আলাদা রাখছে।’
চুক্তির ফল কী হবে
এই চুক্তির ফলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে জোট এলাকার মধ্যে একে একে বেশিরভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক উঠে যাবে। টেলিযোগাযোগ, মেধাসত্ত্ব, ব্যাংক ও বীমার মত আর্থিক সেবা, ই-কমার্স এবং পেশাদারি সেবার মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোও এই চুক্তির আওতায় থাকছে।
তবে সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, ‘রুলস অব অরিজিন’ অর্থাৎ কোন দেশ থেকে পণ্য আসছে তার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হবে। সিঙ্গাপুর থেকে বিবিসির টিম ম্যাকডোনাল্ড বলছেন, রুলস অব অরিজিনের সংজ্ঞায় পরিবর্তনের প্রভাব হবে বিশাল। এসব সদস্য দেশগুলোর অনেকেরই নিজেদের মধ্যে এরই মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, কিন্তু তাতে রুলস অব অরিজিন সম্পর্কিত নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে।
এশিয়ান ট্রেড সেন্টারের ডেবোরা এমস বলেন, ‘এখন যেসব মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, তা আরসিইপির তুলনায় অনেক জটিল।’
কোনো সদস্য দেশ যদি তাদের উৎপাদিত পণ্যে ভিন্ন কোনো দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে, তাহলে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থাকলেও তাদের আমদানি শুল্ক গুণতে হয়। যেমন, ইন্দোনেশিয়া যদি তাদের তৈরি কোনো যন্ত্রে অন্য কোনো দেশের আমদানি করা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে, তাহলে আসিয়ানভুক্ত অন্য দেশে তা রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হতে পারে।
তবে আরসিইপি চুক্তিতে সদস্য দেশগুলো থেকে যন্ত্রাংশ কিনলে রপ্তানিতে কোনো সমস্যা হবে না। এ বিষয়টিকেই আসিয়ান জোটের সদস্যদের নতুন এই বাণিজ্য চুক্তিতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। তবে এর চেয়েও বড় আকর্ষণ চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ।