ডেস্ক নিউজ : কোরআন মহানবী (সা.)-কে দানকৃত অন্যতম প্রধান ও শ্রেষ্ঠতর মুজিজা (অলৌকিক বিষয়)। অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত অনুসন্ধানী মানুষের জন্য এক মহাবিস্ময়। বিশেষত কোরআনের ভাষাশৈলী ও সৌন্দর্য আরবি ভাষা-সাহিত্যের এক অন্তহীন ভাণ্ডার। প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত অসংখ্য আরবি ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক কোরআনের শিল্প-শৈলী নিয়ে কাজ করেছেন, আজীবন এ কাজেই নিমগ্ন থেকেছেন। অথচ ভাষা-সাহিত্যের শিল্প রহস্য ও প্রাসাদগুণ অনুসন্ধানে লেগে থাকা, রুচিবোধ অর্জন করা চাট্টিখানি কথা নয়। কোরআন তিলাওয়াত করা পুণ্যের কাজ, তার অর্থ বোঝার চেষ্টা করাও আবশ্যক—যাতে আরো বেশি পুণ্য মেলে। অন্যদিকে কোরআনের ভাষাশৈলী ও অলংকারশাস্ত্র সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘ সাধনার। কেননা অলংকারশাস্ত্রে অবগাহনের জন্য আরবি ভাষা ও সাহিত্যে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজন হয়, দরকার হয় উচ্চতর সাহিত্য-রুচি এবং ইলমুল মাআনি ও ইলমুল বদি (আরবি অলংকারশাস্ত্রের দুটি শাখা)-তে বিশেষ পারদর্শিতা। আরো প্রয়োজন হয় প্রাচীন ও আধুনিক আরব কবিতা-গদ্য সাহিত্যের গভীর অধ্যয়ন। সর্বোপরি আল্লাহর অনুগ্রহ ও কৃপার মুখাপেক্ষী হন মুমিন সাধক-সাহিত্যিক।
কোরআনের এ অসামান্য শিল্প শক্তির কারণেই মহান আল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত আগত সব যুগের সব সাহিত্যিক ও ভাষাবিদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রেখেছেন—তোমরা পারলে কোরআনের আয়াতের মতো একটি আয়াত সৃষ্টি করে দেখাও। যে আরব জাতি নিজেদের ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গর্ব করত, তারা কোরআনে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে। কোরআনের বিস্ময়কর ভাষাশৈলী তাদের হতবাক ও হতবিহ্বল করে দেয় এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। মক্কার মুশরিকরা কোরআনের অপরাজেয় সাহিত্য সৌকর্য ও তার অপ্রতিরোধ্য প্রভাব উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এ জন্য তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল যেন মানুষ কোরআন না শোনে, হজে আসা আরবদের তারা কোরআনবিমুখ করতে, মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে বিরত রাখতে নানা তৎপরতা চালায়। তারা কোরআনের ব্যাপারে প্রচার করে এটি এমন জাদু, যা গোত্রের ভেতর বিরোধ তৈরি করে। তাদের সব তৎপরতার পরও যে কোরআন শুনেছে সে ঈমান তার ওপর ঈমান এনেছে; বরং ঈমান আনতে বাধ্য হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে তার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
সিরাতে ইবনে হিশামের বর্ণনা মতে, জুবায়ের ইবনে মুতয়িম (রা.) কোনো কাজে মহানবী (সা.)-এর কাছে আসেন। তখন মহানবী (সা.) সুরা তিলাওয়াত করছিলেন। যখন তিনি পাঠ করলেন—‘নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালকের শাস্তি অবধারিত এবং তা প্রতিহত করার মতো কেউ নেই’ তখন তার ভেতর কম্পন সৃষ্টি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন। ‘আকাবা’র প্রথম শপথের সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআন তিলাওয়াত করেন এবং উপস্থিত সবাই ইসলাম গ্রহণ করেন। তারা মদিনায় ফিরে গিয়ে কোরআনের অপরাজেয় প্রভাবের কথা প্রচার করে এবং ঘরে ঘরে ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেয়। বলা যায়, কোরআনের বদৌলতে মদিনায় ইসলামের উত্থান ঘটে।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-ও কোরআন তিলাওয়াত শুনে ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হন। ইসলাম গ্রহণের আগে মদিনার উসাইদ বিন হুদাইর (রা.) মুসআব ইবনে উমাইয়ের (রা.)-কে হত্যার প্রতিজ্ঞা করেন এবং কোরআন তিলাওয়াত শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। নিঃসন্দেহে তাদের হৃদয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পেছনে কোরআনের অন্তর্নিহিত শক্তির পাশাপাশি তার ভাষাগত উৎকর্ষও ভূমিকা রেখেছে। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাই বলে দিয়েছিল কোরআন কোনো মানুষের বাণী হতে পারে না। তা ভিন্ন কোনো উৎস থেকে এসেছে।
একাধিক কুরাইশ সর্দার গোপনে কোরআন শুনত এবং তারা কোরআন দ্বারা প্রভাবিতও ছিল। একবার কুরাইশরা উতবা ইবনে রাবিআকে সমঝোতার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে পাঠাল। মহানবী (সা.) তার কথা শোনার পর সুরা ফুসসিলাত তিলাওয়াত করলেন। এরপর উতবা যখন ফেরে লক্ষ করা গেল তার চেহারা বদলে গেছে। নাজ্জাসির দরবারে জাফর (রা.) সুরা মারিয়াম তিলাওয়াত করলে তিনি অশ্রুসিক্ত হন এবং বলেন, আল্লাহর শপথ! এ বাণী ও ইঞ্জিল একই প্রদীপের দুটি সলতে। ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা কুরাইশের একজন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য নেতা ছিলেন। একবার মহানবী (সা.)-এর কাছে এলেন এবং কিছু আয়াত তিলাওয়াতের অনুরোধ করলেন। মহানবী (সা.) কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে শোনালে, তিনি আরো কিছু আয়াত শোনার অনুরোধ করলেন। যা শুনে তিনি খুব প্রভাবিত হলেন এবং বললেন, এসব বাক্যে ভিন্ন মাধুর্য ও প্রাণ রয়েছে। এটাই কোরআন! যা মানুষের হৃদয়কে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। পাথর হৃদয়কে মোমে পরিণত করে। অথচ কোরআন না কোনো জাদুমন্ত্র, না কোনো কবিতা।
যদি শুধু সুরা ফাতিহার অর্থের ব্যাপকতা, সুন্দর উপস্থাপন, প্রার্থনার ভঙ্গি ও ভাষা, মহান স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন নিয়ে কেউ চিন্তা করে তবে সে ভাষা ও সাহিত্যের অনন্য উচ্চতায় বিমোহিত হবে। ইংরেজি ভাষার একজন বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক বলেছেন, সাহিত্যের ভাষায় প্রতিটি শব্দের ব্যবহার যথার্থ হতে হয়। ঠিক একটি জীবন্ত প্রাণীর শরীরের মতো। যদি একটি শব্দও এদিক-সেদিক হয় তবে পুরো বাক্যটিই রক্তাক্ত হয়। কোরআনের সাহিত্যমান এর চেয়েও বহু ঊর্ধ্বে। তার কোনো শব্দের বিকল্প হিসেবে অন্য শব্দ ব্যবহার করা যায় না। আংটির পাথরের মতো প্রতিটি শব্দই নিখুঁতভাবে বাক্যে প্রোথিত হয়েছে। যেভাবে চাঁদ-তারা আকাশের সৌন্দর্য এবং রঙিন ফুলের বাহার ভূপৃষ্ঠের সৌন্দর্য, তেমনি কোরআনের প্রতিটি শব্দ ও আয়াত শাব্দিক সৌন্দর্যে মণ্ডিত। চাঁদ-তারা ও ফুলের সৌন্দর্য যেমন অন্ধ ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পারে না, তেমনিভাবে আরবি ভাষার অলংকারশাস্ত্রে অপারদর্শী ব্যক্তির পক্ষে কোরআনের সাহিত্য সুষমা উপলব্ধি করা সম্ভব না।
যেহেতু আরবি ভাষায় গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন ছাড়া তার ভাষাগত সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না, তাই বেশির ভাগ কোরআন অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকার কোরআনের ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা এড়িয়ে গেছেন। অথচ বেশির ভাগ আরবি ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক কোরআনকে মৌলিক সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছেন। কোরআন গবেষক আলেমদের বড় অংশই বলেছেন, কোরআন তার উচ্চমার্গীয় ভাষা ও শৈলীর কারণে মুজিজা (অলৌকিক বিষয়) হিসেবে গণ্য। অন্যদিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) আল ফাউজুল কাবির গ্রন্থে বিধানাবলি, শিক্ষা ও পথনির্দেশের কারণে কোরআনকে মুজিজা আখ্যা দিয়েছেন। তবে এটাই সঠিক অভিমত যে কোরআন সার্বিক বিবেচনাতেই অলৌকিক।
তামিরে হায়াত থেকে
আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর