শুক্রবার, ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সারাহ গিলবার্ট: যার ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : করোনা মহামারির এই সময়ে ভ্যাকসিন বিজ্ঞানীদের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত নাম- অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট। করোনার সম্ভাব্য ভ্যাকসিন তৈরির পথে অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নারী বিজ্ঞানীর নেতৃত্বাধীন গবেষকদল।

ইতোমধ্যে মানবদেহে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন। এখন অপেক্ষা তৃতীয় ধাপের ফলের জন্য, যা জানা যাবে আগস্ট মাসের শেষে। এই ফল ইতিবাচক হলেই করোনায় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় অনুমোদন পেয়ে যাবে বহুল আলোচিত এই ভ্যাকসিন- এমনটাই বলছে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’। সংবাদমাধ্যমটির মতে, অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণিত হলে অক্টোবরের মধ্যেই এই ভ্যাকসিন বাজারে নিয়ে আসবে ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা।

বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, ভ্যাকসিন ছাড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থামানো সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে কার্যকর ভ্যাকসিনের। বিশ্বে ইতোমধ্যে করোনার ১৭০টি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই মুহূর্তে ২১টি ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আশার আলো দেখাচ্ছে অক্সফোর্ডের সারাহ গিলবার্টের ভ্যাকসিন। পৃথিবী তাকিয়ে আছে এই ভ্যাকসিনের সর্বশেষ ফল জানতে।

আশাবাদী হওয়ার পেছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। অধ্যাপক গিলবার্ট এর আগে ইবোলা ভাইরাসের সফল ভ্যাকসিন তৈরি করে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। উদীয়মান সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে গিলবার্ট ও তার দলের রয়েছে বিস্তর অভিজ্ঞতা। মজার তথ্য হলো, ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ হওয়া কিন্তু গিলবার্টের পরিকল্পনায় ছিল না। ঘটনাক্রমে তিনি গবেষণায় জড়িয়ে পড়েন। যুক্তরাজ্যের একটি সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে গিলবার্ট বলেন, ‘অক্সফোর্ডে আমি আসলে হিউম্যান জেনেটিক্সের একটি প্রোজেক্টের গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। তখন ঘটনাক্রমে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে বিশেষ ধরনের ইমিউন রেসপন্স আবিষ্কার করি। ফলে পরবর্তী সময়ে এ ধরনের ইমিউন রেসপন্স উপযোগী ভ্যাকসিন তৈরি করাটাই কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই ভ্যাকসিনের গবেষণায় আমার প্রবেশ।’

স্কুলজীবন থেকেই মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক ছিল গিলবার্টের। তিনি বায়োলজিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক। গবেষক হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। ১৯৯৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন হিউম্যান জেনেটিক্সের একটি প্রজেক্টের গবেষক হিসেবে। ২০০৪ সালে ভ্যাক্সিনোলজির রিডার হিসেবে নিয়োগ করা হয় তাকে। ২০১০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান জেনার ইনস্টিটিউটি যোগ দেন তিনি। অধ্যাপক গিলবার্ট অক্সফোর্ডের বায়োটেক প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিটেকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। বিভিন্ন সংক্রামক রোগের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল গবেষণা নিয়ে ভ্যাকসিটেক কাজ করে।

গবেষণায় এই নারী বিজ্ঞানীর পুরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারার পেছনে তার জীবনসঙ্গীর অবদান অনেক। ১৯৯৮ সালে গিলবার্ট একসঙ্গে ৩ সন্তানের জন্ম দেন। বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য তার সঙ্গীকে ক্যারিয়ার ত্যাগ করতে হয়েছিল। অথচ গিলবার্ট তখনও কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি ভাগ্যবান, কারণ এমন একজন জীবনসঙ্গী পেয়েছেন যে তার মেধার যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। বুঝতে পেরেছেন গিলবার্টের কাজ কতোটুকু মনোযোগ দাবি করে। গিলবার্টের মতে, ‘পরিবারের সমর্থন না পেলে নারীদের পেশাগত কাজে সফল হওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার।’

তবে গিলবার্ট এমন এক ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন যেখানে এখনো পুরুষের আধিপত্য বেশি। যুক্তরাজ্যের উইম্যান ইন সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তথ্যানুসারে, দেশটিতে বিজ্ঞানে পেশাজীবী নারীর সংখ্যা বর্তমানে ৪৫.৭ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাপী নারী গবেষকদের সংখ্যা ৩০ শতাংশেরও কম। যুক্তরাজ্যে পুরুষ-নারী বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেতনের ব্যবধানও রয়েছে। নিউ সায়েন্টিস্টের ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদন বলা হয়েছে, নারী বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীদের গড়ে যেখানে বার্ষিক ৩৫,৬০০ ব্রিটিশ পাউন্ড রোজগার হয়, সেখানে পুরুষদের গড়ে বার্ষিক রোজগার ৪৫,৮০০ ব্রিটিশ পাউন্ড।

এছাড়া ঐতিহাসিকভাবেই অনেক অগ্রণী গবেষণায় নারী গবেষকরা প্রাপ্ত স্বীকৃতি পাননি। চাঁদের মাটিতে মানুষের প্রথম পা রাখা ‘অ্যাপোলো-১১’ মিশনে যুগান্তকারী অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গণিতবিদ ক্যাথরিন জনসন বছরের পর বছর অবহেলিত ছিলেন। ডিএনএ আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যুক্তরাজ্যের রসায়নবিদ রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের মৃত্যুর বহু বছর পর গত বছর একটি স্পেস রোবটের নামে তার নামকরণ করে তাকে সম্মানিত করা হয়।

তবে মানব জাতির কল্যাণে দীর্ঘদিন ধরে নিরলস পরিশ্রম করে যাওয়ার জন্য অধ্যাপক গিলবার্টকে খুব শিগগির তার প্রচেষ্টার জন্য সম্মানিত করা উচিত বলে মনে করেন অনেকে। জেনার ইনস্টিটিউট- যেখানে অক্সফোর্ডের করোনার ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে, এটি অ্যাডওয়ার্ড জেনারের নামে করা হয়েছিল। অ্যাডওয়ার্ড জেনার গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথিকৃৎ। সম্ভবত অধ্যাপক গিলবার্টও সেই পথেই হাঁটছেন। তিনি এই মুহূর্তে বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত একজন নারী গবেষক।

তথ্যসূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ

এই বিভাগের আরো খবর