ডেস্ক নিউজ : একজন মা, একজন সমাজকর্মী, একজন রাজনীতিবিদ, একজন স্ত্রী-সহযোদ্ধা, একজন নেতা সর্বোপরি একজন আদর্শ ব্যক্তিত্বের নাম আইভি রহমান। বাংলাদেশের সমাজ উন্নয়ন ও নারীমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা আইভি রহমান (পুরো নাম জেবুন্নাহার আইভি) ১৯৪৪ সালের ৭ জুলাই ভৈরব উপজেলার চণ্ডিবের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আট বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে পঞ্চম আইভি রহমান বেড়ে ওঠেন যৌথ পরিবারের শাসন-স্নেহে। আইভি রহমানের মা হাসিনা বেগম ছিলেন গৃহিণী এবং বাবা জালালউদ্দিন আহমেদ ছিলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে জালালউদ্দিন আহমেদ খ্যাতি অর্জন করেছেন।
আইভি রহমানের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় জন্মভূমি ভৈরবে। তিনি ঢাকার বাংলাবাজার স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৬০ সালে। ১৯৬৯ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে স্নাতক এবং ১৯৭২-৭৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ১৯৫৮ সালের ২৭ জুন আইভি রহমান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। তাঁদের দুই কন্যা তানিয়া বাখ্ত ও তনিমা রহমান ময়না এবং একমাত্র পুত্র নাজমুল হাসান পাপন। আইভি রহমানের বড় বোন শামসুন্নাহার সিদ্দিক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার শাশুড়ি। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছাড়াও আইভি রহমান ও তাঁর পরিবার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কারণে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
পারিবারিক মূল্যবোধের প্রভাবে কিশোর বয়সেই আইভি রহমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন। ছাত্রজীবনেই তিনি অংশগ্রহণ করেন বাঙালির অধিকার আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক জীবনের শুরু। এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সম্পৃক্ত ছিলেন রাজনীতিতে।
১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সময় আইভি রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় আইয়ুববিরোধী আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। আইভি রহমান বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এবং বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনি রাইফেল ও ফাস্ট এইড প্রশিক্ষণ নেন। পরিচালনা করেন অন্য নারীদের প্রশিক্ষণও। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারেও কাজ করেছেন। মা, মাটি, দেশ ও স্বাধীনতা বিষয়ক বিভিন্ন কথিকার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও উদ্যম সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আইভি রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
আইভি রহমান ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৮০ সালে। ১৯৮০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও আইভি রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ মহিলা সমিতি পুনর্গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আইভি রহমান জাতীয় মহিলা সংস্থা ও জাতীয় মহিলা সমিতির সভাপতি ছিলেন। জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
আইভি রহমান তাঁর জীবনব্যাপী রাজনীতি ও সমাজসেবার মাধ্যমে দেশ ও দেশের মানুষের, বিশেষ করে পশ্চাৎপদ নারীসমাজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নারীসমাজকে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে। নারী হলেও তাঁর সমসাময়িক প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন পুরোভাগে।
মরহুম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের আন্দোলন-সংগ্রাম ও বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো ছায়াসঙ্গী হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন আইভি রহমান। পরিবার ও সন্তান-সন্ততির প্রতি দায়িত্ব পালনেও তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান। মরহুম জিল্লুর রহমান একজন ভদ্র ও উদার রাজনীতিকের আদর্শ হিসেবে চিরঞ্জীব হয়েছেন। তাঁর একমাত্র পুত্র নাজমুল হাসান পাপন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের ডিগ্রিধারী এবং সফল সংগঠক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। বর্তমানে নাজমুল হাসান পাপন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি ও ভৈরব-কুলিয়ার চর আসনের সংসদ সদস্য।
দিনটি ছিল ২১ আগস্ট ২০০৪। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত জনসভা। আইভি রহমান উপস্থিত হন যথাসময়ে। জনসভায় হঠাৎ শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। নারকীয় এ হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হয় অনেক নেতাকর্মী। জনসভার প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা আল্লাহর অসীম রহমতে প্রাণে বেঁচে যান। সামনের সারিতে থাকা আইভি রহমানসহ আরো অনেকে গুরুতর আহত হন। মুমূর্ষু অবস্থায় আইভি রহমানকে ভর্তি করা হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। তিন দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৪ আগস্ট চিরতরে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তিনি। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর এক মাস ১৭ দিন।
অকুতোভয় নেত্রী আইভি রহমান আজ আমাদের মাঝে নেই, রয়েছে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ অবদান। ২১ আগস্ট অনুষ্ঠিত জনসভার কিছুদিন আগেও ভৈরবের বন্যাদুর্গত মানুষের সাহায্যে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আইভি রহমান। মুক্তিযুদ্ধ এবং সমাজসেবায় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখার জন্য আইভি রহমানকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয় স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ২০০৯-এ।
তাঁর জন্মস্থান ভৈরবের চণ্ডিবের গ্রামে নির্মাণ করা হয়েছে আইভি রহমান স্মৃতিস্তম্ভ। তাঁর নামে নামকরণ হয়েছে জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজের ছাত্রীনিবাস ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের একটি তোরণ। আজীবন সংগ্রামী, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহীয়সী ব্যক্তিত্ব আইভি রহমানের শ্রদ্ধার্থে হয়তো প্রতিষ্ঠা করা হবে আরো অনেক কিছু। বেঁচে থাকবে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল কর্ম। আন্দোলন-সংগ্রামরত অবস্থায় জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে আইভি রহমান প্রমাণ করেছেন, দেশ ও দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যই তাঁর অধিষ্ঠান। শ্রদ্ধা জানাই, মহীয়সী আইভি রহমান।