রবিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইমাম মেহেদী (আঃ) পৃথিবীতে আগমনের সময় হওয়ার লক্ষণ গুলো!

মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা হযরত ইমাম মাহদী (আ.)’র পবিত্র জন্মদিন হল ১৫ ই শাবান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের ১১ তম সদস্য ইমাম হযরত ইমাম হাসান আসকারী (আ.)’র পুত্র হিসেবে (আজ হতে ১১৮১ চন্দ্রবছর আগে) তাঁর জন্ম হয়েছিল ২২৫ হিজরিতে ইরাকের (বর্তমান রাজধানী বাগদাদের উত্তরে) পবিত্র সামেরা শহরে।

তাঁর মায়ের নাম ছিল নার্গিস এবং তিনি মহান আল্লাহর আদেশে এক পর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যান। তাঁর অদৃশ্য থাকার সময়ও দুই ভাগে বিভক্ত। স্বল্পকালীন সময়ের জন্য অদৃশ্য হওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে অদৃশ্য থাকা। দীর্ঘ মেয়াদে অদৃশ্য থাকার পর উপযুক্ত সময়ে তিনি আবার আবির্ভূত হবেন (যেভাবে মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আবারও ফিরে আসবেন ঈসা-আ.) এবং সব ধরনের জুলুম ও বৈষম্যের অবসান ঘাটিয়ে বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার ও ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। অতীত যুগের সুন্নি মনীষী ও আলেম সমাজের অনেকেই এই মহান ইমামের জন্ম গ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন।

ইমাম মাহদির (আ.) আবির্ভাবের যুগে পৃথিবী, বিশেষ করে যে অঞ্চলে ইমাম মাহদি (আ.) আবির্ভূত হবেন সেই অঞ্চল, যেমন ইয়েমেন, হিজায, ইরান, ইরাক, শাম (সিরিয়া, লেবানন ও জর্দান), ফিলিস্তিন, মিশর ও মাগরিবের (মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও লিবিয়া) যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা ছোট-বড় অনেক ঘটনা এবং বহু ব্যক্তি ও স্থানের নামকে শামিল করে।
বেশ কিছু সংখ্যক রেওয়ায়েত ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পরপরই পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হযরত ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের বিপ্লব ও আন্দোলন শুরু হয়ে যাবে।

কিন্তু আঞ্চলিক পর্যায়ে ইমাম মাহদি (আ.)-এর সমর্থক দু’টি সরকার ও প্রশাসন ইরান আর ইয়েমেনে প্রতিষ্ঠিত হবে। মাহদি (আ.)-এর ইরানী সঙ্গী-সাথীরা তাঁর আবির্ভাবের বেশ কিছুকাল আগে নিজেদের একটি সরকার গঠন করে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। অবশেষে তারা ঐ যুদ্ধে বিজয়ী হবে।

ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের কিছুকাল আগে ইরানীদের মধ্যে দু’ব্যক্তি (একজন খোরাসানী সাইয়্যেদ তথা বিশ্বনবী-(সা.)’র বংশধর যিনি হবেন রাজনৈতিক নেতা এবং অপরজন শুআইব ইবনে সালিহ্ যিনি হবেন সামরিক নেতা) আবির্ভূত হবেন এবং এ দু’ব্যক্তির নেতৃত্বে ইরানী জাতি তাঁর আবির্ভাবের আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

কিন্তু ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের কয়েক মাস আগে তাঁর ইয়েমেনী সঙ্গী-সাথিগণের বিপ্লব ও অভ্যুত্থান বিজয় লাভ করবে এবং তারা বাহ্যত হিজাযে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে তা পূরণ করার জন্য তাঁকে সাহায্য করবে। হিজাযের এ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ার কারণ হচ্ছে হিজাযের কোন এক বংশের এক নির্বোধ ব্যক্তি যার নাম হলো আবদুল্লাহ্, সে দেশের সর্বশেষ বাদশাহ্ হিসেবে নিহত হবে এবং তার স্থলাভিষিক্ত কে হবে- এ বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন এক মতবিরোধের সৃষ্টি হবে যা ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে।

“যখন আবদুল্লাহর মৃত্যু হবে, তখন জনগণ কোন্ ব্যক্তি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবে- এ ব্যাপারে কোন ঐকমত্যে পৌঁছতে পারবে না। আর এ অবস্থা ‘যুগের অধিপতি’র (ইমাম মাহদির) আবির্ভাব পর্যন্ত চলতে থাকবে। বহু বছর রাজত্ব করার দিন শেষ হয়ে কয়েক মাস বা কয়েক দিনের রাজত্ব করার অর্থাৎ ক্ষণস্থায়ী শাসনের পালা চলে আসবে।”

আবু বসীর বলেন : “আমি জিজ্ঞাসা করলাম : এ অবস্থা কি দীর্ঘকাল স্থায়ী হবে? তিনি বললেন : কখনই না। বাদশাহ (আবদুল্লাহর) হত্যাকাণ্ডের পরে এ দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হিজাযের গোত্রগুলোর মধ্যকার সংঘাত ও কলহে পর্যবসিত হবে।”

“(ইমাম মাহদির) আবির্ভাবের নিদর্শনগুলোর অন্যতম হচ্ছে ঐ ঘটনা যা দু’হারামের (মক্কা ও মদিনা) মাঝখানে সংঘটিত হবে। আমি বললাম : কোন্ ঘটনা ঘটবে? তিনি বললেন : দু’হারামের মাঝে গোত্রীয় গোঁড়ামির উদ্ভব হবে এবং অমুকের বংশধরদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বিরোধী গোত্রের ১৫ জন নেতা ও ব্যক্তিত্বকে অথবা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে।”

এ সময়ই ইমাম মাহদি (আ.)-এর আবির্ভাবের নিদর্শনগুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং সম্ভবত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় নিদর্শন হচ্ছে আসমানি আহ্বান বা ধ্বনি যা তাঁর নামে ২৩ রমজানে শোনা যাবে। বিভিন্ন ইসলামী বর্ণনা ও হাদিস অনুযায়ী দিনটি হবে শুক্রবার।

তাঁর শত্রুরা তাঁর আবির্ভাবের ব্যাপারে খুব ভীত হয়ে পড়বে এবং এ কারণে তারা তাঁকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করবে। জনগণের মাঝে ছড়িয়ে যাবে যে, তিনি মদিনায় অবস্থান করছেন। বিদেশী সামরিক বাহিনী অথবা হিজায সরকার সে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনয়ন এবং সরকারের সাথে গোত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করার জন্য সিরিয়াস্থ সুফিয়ানী সেনাবাহিনীর সাহায্য চাইবে।(হাদিস বা ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী সুফিয়ানী বাহিনীর নেতা সুফিয়ানী হবে মুয়াবিয়ার বংশধর) এ সেনাবাহিনী মদিনায় প্রবেশ করে হাশেমী বংশীয় যাকে পাবে তাকেই গ্রেফতার করবে। তাদের অনেককে এবং তাদের অনুসারীদেরকে হত্যা করবে এবং অবশিষ্টদেরকে জেলখানায় বন্দী করে রাখবে।

“সুফিয়ানী তার একদল সৈন্যকে মদিনায় প্রেরণ করবে এবং তারা সেখানে এক ব্যক্তিকে হত্যা করবে। মাহদি ও মানসূর সেখান থেকে পলায়ন করবেন। তারা মহানবীর (সা.) সকল বংশধরকে গ্রেফতার করবে। আর এর ফলে কোন ব্যক্তিই মুক্ত থাকবে না। সুফিয়ানী বাহিনী ঐ দু’ব্যক্তিকে ধরার জন্য মদিনা নগরীর বাইরে যাবে এবং ইমাম মাহদি (ফিরআউনের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যাপারে) হযরত মুসা (আ.)-এর মতো ভীত ও চিন্তিত অবস্থায় সেখান থেকে বের হয়ে মক্কাভিমুখে চলে যাবেন।”
অতঃপর ইমাম মাহদি (আ.) মক্কা নগরীতে তাঁর কতিপয় সঙ্গী-সাথীর সাথে যোগাযোগ করবেন যাতে করে তিনি পবিত্র হারাম থেকে এশার নামাযের পরে মুহররম মাসের দশম রাতে (আশুরার রাতে) তাঁর আন্দোলনের সূচনা করতে পারেন। তখন তিনি মক্কার জনগণের উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণ দান করবেন। এর ফলে তাঁর শত্রু রা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাঁর সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে এবং শত্রু দেরকে বিতাড়িত করে প্রথমে মসজিদুল হারাম ও তারপর পবিত্র মক্কা নগরীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।

মুহররম মাসের দশম দিবসের (আশুরার দিবস) প্রভাতে ইমাম মাহদি সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর বাণী প্রদান করে বিশ্বের জাতিগুলোকে আহ্বান জানাবেন যাতে করে তারা তাঁকে সাহায্য করে। তিনি ঘোষণা করবেন যে, যে মুজিযার প্রতিশ্র“তি তাঁর শ্রদ্ধেয় প্রপিতামহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) দিয়েছিলেন তা ঘটা পর্যন্ত তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থান করবেন। আর উক্ত মুজিযা হবে ইমাম মাহদি (আ.)-এর আন্দোলন দমন করার জন্য পবিত্র মক্কাভিমুখে অগ্রসরমান সুফিয়ানী প্রেরিত বাহিনীর ভূ-গর্ভে প্রোথিত হওয়া

এ মুজিযার পর ইমাম মাহদি (আ.) ১০ হাজারেরও বেশি সেনা নিয়ে মক্কা থেকে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং শত্রু বাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর সেখানে অবস্থান গ্রহণ এবং মদিনা শত্রু মুক্ত করবেন। এরপর তিনি দুই হারাম (মক্কা ও মদিনা) মুক্ত করার মাধ্যমে হিজায বিজয় এবং সমগ্র অঞ্চলের (আরব উপদ্বীপ) ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন।
এরপর তিনি ইরাককে তাঁর প্রশাসনের কেন্দ্র এবং কুফা নগরীকে রাজধানী হিসাবে মনোনীত করবেন। আর এভাবে ইয়েমেন, হিজায, ইরাক এবং পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো সর্বতোভাবে তাঁর শাসনাধীনে চলে আসবে।

রেওয়ায়েতগুলো এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইরাক বিজয়ের পর ইমাম মাহদি (আ.) সর্বপ্রথম যে যুদ্ধের উদ্যোগ নেবেন তা হবে তুর্কীদের সাথে তাঁর যুদ্ধ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে :

أول لواء يعقده يبعثه إلى التّرك فيهزمهم

“প্রথম যে সেনাদল তিনি গঠন করবেন তা তিনি তুর্কদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করবেন। অতঃপর তা তাদেরকে পরাজিত করবে।”
বাহ্যত তুর্কী বলতে রুশদেরকেও বোঝানো হতে পারে যারা রোমানদের (পাশ্চাত্যের) সাথে যুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়বে।
ইমাম মাহদি (আ.) সেনাদল গঠন করার পর তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীকে কুদসে (জেরুজালেম) প্রেরণ করবেন। এ সময় তাঁর সেনাবাহিনী দামেস্কের কাছে ‘মার্জ আযরা’ এলাকায় আগমন করা পর্যন্ত সুফিয়ানী পশ্চাদপসরণ করতে থাকবে এবং তাঁর ও সুফিয়ানীর মাঝে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। তবে ইমাম মাহদি (আ.)-এর প্রতি জনসমর্থন বহুগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাঁর সামনে সুফিয়ানীর অবস্থান এতটা দুর্বল হয়ে পড়বে যে, রেওয়ায়েত থেকে প্রতীয়মান হয় সুফিয়ানী তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইবে। কিন্তু এ কাজের জন্য তার ইহুদী-রোমান মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক এবং তার সঙ্গী-সাথীরা তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করবে।
তারা তাদের সেনাবাহিনী মোতায়েন করার পর ইমাম মাহদি (আ.) ও তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে এক বিরাট যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এ যুদ্ধের উপকূলীয় অক্ষরেখাগুলো ফিলিস্তিনের আক্কা (عكّا) থেকে তুরস্কের আনতাকিয়াহ্ (انطاكية) পর্যন্ত এবং ভিতরের দিকে তাবারীয়াহ্ থেকে দামেস্ক ও কুদস পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। (তাবারীয়াহ্ শহর এবং এ শহরের প্রসিদ্ধ হ্রদটি জবর-দখলকৃত ফিলিস্তিনে তথা বর্তমান ইহুদিবাদী ইসরাইলে অবস্থিত)।

এ সময় সুফিয়ানী, ইহুদী এবং রোমান সেনাবাহিনী মহান আল্লাহর(ঐশী) ক্রোধে পতিত হবে এবং তারা মুসলমানদের হাতে এমনভাবে নিহত হতে থাকবে যে, তাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি যদি কোন প্রস্তরখণ্ডের পিছনেও লুকায় তখন ঐ প্রস্তরখণ্ড চিৎকার করে বলে উঠবে : “হে মুসলমান! এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। তাকে হত্যা করো।”
এ সময় মহান আল্লাহর সাহায্য ইমাম মাহদি (আ.) ও মুসলমানদের কাছে আসবে এবং তাঁরা বিজয়ী বেশে আল কুদসে প্রবেশ করবেন।

খ্রিস্টান পাশ্চাত্য আকস্মিকভাবে ইমাম মাহদি (আ.)-এর হাতে ইহুদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তিসমূহের পরাজয় বরণের কথা জানতে পারবে। তাদের ক্রোধাগ্নি প্রজ্বলিত হবে এবং তারা ইমাম মাহদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
ঠিক একইভাবে আরো কিছু হাদিস থেকে জানা যায় যে, এ যুদ্ধের ফলে সংঘটিত জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও তার আগে ও পরে সমগ্র বিশ্বব্যাপী যে প্লেগ বা মহামারী দেখা দেবে তাতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ধ্বংস হবে। তবে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যতীত মুসলমানগণ সরাসরি এ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হবে না।

এই বিভাগের আরো খবর