যখন কোন একটা বিপদ তোমাদের উপর বর্তায় (উহুদের যুদ্ধকালীন) যদিও তোমরা এর আগে (বদরের যুদ্ধে শত্রুদের মাঝে) এর চেয়ে ও দ্বিগুণের মাঝে পরিবেষ্টিত ছিলে তোমরা বল, “এগুলো কোথা থেকে এলো?” বল, “এগুলো তোমাদের থেকেই এসেছে”। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সব কিছু করতে সক্ষম। (৩-১৬৫)
আমি সুরা আল ইমরানের ১৬৫ নাম্বার আয়াত আপনাদের সাথে খুব সুনির্দিষ্ট একটু উদ্দেশ্যে আলোচনা করতে চাই। অনেক মানুষই প্রশ্ন করেন কেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদেরকে কঠিন সময়ে ফেলেছেন এবং এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। ওনারা জানতে চান কি এমন ওনারা করেছেন যে এইরকম কষ্টের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে। এবং কখনো কখনো মানুষ এটাও বলে, যখন খারাপ কিছু হয়, এটা হয়েছে কারণ, “আমি কিছু খারাপ কাজ করেছি, কারণ এটা আমারই ভুল নয়তো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এরকম ইচ্ছা করেছেন আমার পরীক্ষা নিতে। আমি কিভাবে বুঝবো কোনটা আসল কারণ?”
আবার কিছু মানুষ আছে যারা যখনই তাদের উপর কোন বিপদ আসে, তারা নিজেদেরকে এর জন্য দোষারোপ করে। তারা শুধু বলে, “আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ন্যায়বান. নিশ্চয়ই আমিই কিছু অন্যায় করেছি, আমি নিশ্চয়ই আমার পিতামাতার সাথে খারাপ আচরণ করেছি অথবা অন্য কিছু, এবং এই কারণে আমার গাড়ী এক্সিডেন্ট করেছে অথবা অন্যকিছু”। তারা অদৃশ্য থেকে দৃশ্যমান জগতে মনোযোগী হয়।
এখন কিছু আয়াত আছে যা আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করবে, একদিকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন, যেমন এই আয়াতে, আওয়া লাম্মা আসাবাকতুম মুসীবাতুনক্বাদ আসাবতুম মিছলায়হা
যখন উহুদের যুদ্ধে মুসলমানেরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছিলো, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন, “যখন তোমরা কোন বিপর্যয়ে আক্রান্ত হও, যেরকমটি তোমাদের শত্রুদের থেকে আগে ও এসেছে এবং তোমরা পরাহত করেছ”
(ক্বাদ আসাবতুম মিছলায়হা)
“আগের বছরই এরচেয়ে দ্বিগুণ ক্ষয়-ক্ষতি তোমরা তোমাদের শত্রুদের করেছ”।
ক্বুলতুম আন্না হাথা তোমরা বললে, “এটা কীভাবে সম্ভব? আল্লাহ কী করে এরকম হতে দিতে পারেন?”
ক্বুল হুয়া মিন আ’ইন্দি আনফুসিকুম তাদের বলে দাও, “তোমাদের মধ্যে যা আছে সে কারণেই এটা হয়েছে”। এটা স্পষ্টতই তোমাদের মাঝ থেকে এসেছে। এটা শুধুমাত্র তোমাদের ভুলের কারণে। ইন্না আল্লাহা আ’লাকুল্লি শায়-ইন ক্বাদীর
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আসলেই সবকিছু করতে সক্ষম। অন্যভাবে বললে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যদি না চাইতেন এটা ঘটতো না। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বিপর্যয় রোধ করতে সক্ষম কিন্তু তিনি সেটা ঘটতে দেন। এবং এটা সত্যিকার অর্থে শুধুমাত্র তোমাদেরই কারণে। কুরআনের অন্য জায়গায় আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন,
মা আসাবা মিন মুসীবাতিনিল্লা বি-ইঝনি আল্লাহি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অনুমতি ছাড়া কোন দুর্যোগ, কোন বিপর্যয় তোমাদের আক্রমণ করে না।
তো আপনি কী করে বুঝবেন, একদিকে এটা আপনার ভুলের জন্য আবার অন্যদিকে এটা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার অনুমতিক্রমে? খুব সংক্ষেপে আমি আপনাদের সাথে এ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই যাতে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় ইন শা আল্লাহ্।
যখন আপনি তিন লেনের মাঝে গাড়ী চালাচ্ছেন তাও আবার স্পীড লিমিটের বেশিতে, আপনি এই দিক থেকে ঐ দিকে যাচ্ছেন আবার অন্যদিক করছেন এবং আপনার গাড়ী এক্সিডেন্ট করলো, আপনি তখন এটা বলতে পারেন না যে, আল্লাহ্ চেয়েছেন এক্সিডেন্ট হোক। এটা আমার ভুল নয়। এটা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইচ্ছা। আমি কী করতে পারি? (ইন্না আল্লাহা আ’লাকুল্লি শায়-ইন ক্বাদীর) দুর্যোগ যখন আসে সেটা আল্লাহ্র তরফ থেকে আসে। আপনি এটা বলতে পারেন না। এটা বলতে পারেন না যখন যা ঘটেছে সেটার জন্য আপনি পুরোপুরি দায়ী, আপনার নিজের ভুল, আপনার নিজের দায়িত্ব হীনতার ফলে তা ঘটেছে। এর জন্য আপনি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশের দোহাই দিতে পারেন না।
অন্যদিকে কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা পুরোপুরি আমাদের আয়ত্তের বাইরে। হতে পারে আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ক ব্যাপার পুরোপুরি আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরিবারের কারো মৃত্যু- এটা আপনার আওতার বাইরে। এমনকি গাড়ীর এক্সিডেন্টের ঘটনাও আপনার দায়িত্ব হীনতা ছাড়াও ঘটতে পারে, এটা অন্যের দোষে ঘটতে পারে, ঠিক। আপনি চাকরি হারালেন এবং এটা সম্পূর্ণ আপনার দোষে না ও হতে পারে। আপনার কোন দোষ ছাড়াই হতে পারে। আপনার ব্যবসায় লোকসান ও আপনার কোন ত্রুটি ছারাই হতে পারে। একটা বিপদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেটাতে আপনি আটকা পড়েছেন কিংবা আপনার কোন প্রিয়জন আটকা পড়েছে বা এরকম কিছু, এখানে কাউকে দোষ দেয়ার নেই। ঐ মানুষগুলো পাপী নয় অথবা আপনাকে ও পাপী বলা যাবে না এজন্য। এগুলো আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।
“এসব আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার তরফ থেকে হয়েছে এবং এগুলো পরীক্ষা। এটা শাস্তি নয়”। এই পৃথিবীতে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যখন নবী-রাসুলদের পাঠান এবং মানুষ তাঁদের সতর্কবাণী শোনে না, আল্লাহ্ তখন শাস্তি দেন, পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দেন। অন্য মানুষদের জন্য, আমি বা আপনি জীবনে যা কিছুর মধ্য দিয়ে যাই সবই পরীক্ষা। এবং এখন যখন আপনি কোন কঠিন সমস্যায় পড়েন এবং আপনি খুব সহজেই একটা যোগসূত্র পান যে, “হ্যাঁ আমি এই কাজ করেছি এবং এই জন্য আমার সাথে এটা হয়েছে” আপনি যখন দুটি ঘটনাকে মিলাতে পারবেন, তখন আপনি এই বলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দোহাই দিতে পারেন না যে “ইয়া আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এটা আপনার তরফ থেকে এসেছে, আমার জন্য নয়”। আসলে,
তো স্পষ্টতই কোরআনের অন্যান্য জায়গায় বলা আছে, যখন কোন বর ধরণের বিপর্যয় আসে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তা ঘটতে দেন। যেমন মুসলমানেরা মক্কায় অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, তাই না? মক্কায় তাঁরা নির্যাতিত হয়েছিলেন। এবং ঐ সময়ে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেন বলছেন, “এটা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার তরফ থেকে। তোমরা ধৈর্য ধারণ কর”।
কিন্তু উহুদ যুদ্ধের সময় তীরন্দাজরা তাঁদের যেখানে থাকতে বলা হয়েছিলো সে অবস্থান থেকে সরে গেলেন এবং এই সরে যাওয়ার কারণে মুসলমান সৈন্যদের ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করলেন। এমনকি রাসুল আল্লাহ্ (সাঃ) ও মারাত্মকভাবে আহত হয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন, এবং তাঁদের পাহাড়ের দিকে পিছু হটতে হয়েছিলো।
ইথ তুসা’ইদূনা ওয়ালাতালঊনা আ’লা আহাদিন
তোমরা পাহার বেয়ে উঠছ। তোমরা পেছন ফিরে কারো দিকে তাকাচ্ছ না পর্যন্ত।
যখন এ সবকিছু হচ্ছে, তোমরা এটা বলতে পারো না, “এসব আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা চেয়েছেন বলে ঘটেছে”। না, না, না। এটা তোমাদের কারণে হয়েছে।
হুয়া মিন আ’ইন্দি আনফুসিকুম
আপনি এবং আমি এই আয়াতের মাধ্যমে ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ সম্পর্কে জানাচ্ছি।
আমাদের ঈমানের অংশ হচ্ছে, আমাদের আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে সম্পর্কের একটা অংশ হচ্ছে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে যে সকল বিষয়ে আমরা দায়ী করতে পারি না যার যোগ্য তিনি নন আর আমরা আমাদের নিজেদের দোষ দেই শুধুমাত্র সেসব বিষয়ে যেগুলোর জন্য আমরা দায়ী। আবার বিপরীতটা ও সত্যি। আপনি সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষারোপ করেন না। কিছু কিছু ব্যাপার শুধুমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আওতায়। আল্লাহই ওসব ঘটান এবং আমাদেরকে বুঝতে হবে এই দুটো বিষয়ের সীমারেখা কোথায় টানতে হবে যদি আমরা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে একটি সুন্দর, নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই।
শেষ কথা হলো, কিছু মানুষ আছে যারা এই দুইটি বিষয়ের ব্যালেন্স বুঝতে পারেন না। তাঁদের কি হবে? একদিকে তাঁরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়ে যান, “আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সব করেন, আমি কিছুই না”। সবই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাজ এবং তারা আসলে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ওপর অনেক রেগে যান কারণ, “আল্লাহ্ আমাকে এতো সমস্যায় ফেলেছেন” এবং অন্য দিকে কিছু মানুষ আছে যারা সবকিছুর জন্য নিজেকে দোষারোপ করে এবং নিজেদের নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে।
“আমি এতো খারাপ, আমি এতো বাজে তাই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে চাকরি হারা করলেন এবং এরপর আমার চাকা ফ্ল্যাট হয়ে গেলো, এবং এরপর আমার চুল পড়ে যেতে লাগলো এবং এরপর আমার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে লাগলো,
এবং এরপর আমার ডিভোর্স হয়ে গেলো…এসব কিছুই হয়েছে, এসবই হয়েছে কারণ আমি একটা খারাপ মানুষ কিংবা আমার এসব প্রাপ্য”। তারা নিজেদেরকে ঘৃণা করতে শুরু করে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা চান না আমরা আমাদের নিজেদেরকে ঘৃণা করি এবং তিনি এটা ও চান না যে আমরা তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি। আপনার ভালোবাসা থাকতে হবে, শুধুমাত্র আপনার নিজের জন্য নয়, কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য ঐ ভালোবাসা থেকেই আপনি নিজের জন্য ভালোবাসা আর সম্মানবোধ খুঁজে পেতে পারেন।
এই আয়াতটি আমাদের এই শিক্ষাই দিচ্ছে। যেসব দুর্যোগ আসে, আপনাকে বুঝতে হবে কোনটা আপনার নিজের কাজের ফলে হয়েছে এবং কোনটা সরাসরি আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার তরফ থেকে আপনার পরীক্ষা হিসেবে এসেছে যাতে আপনি ওসব কাটিয়ে উঠতে পারেন।
বারাকআল্লাহু লি ওয়ালাকুম ওয়া-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।