ডেস্ক নিউজ : করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে যুক্তরাজ্য। এখন পর্যন্ত দেশটিতে মারণ এই ভাইরাসে মোট আক্রান্ত হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ২৭৬ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪৪ হাজার ১৩১ জনের।
দেশটিতে করোনার এই মহামারীর সময়ে সামনের সারিতে থেকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে বর্ষসেরা চিকিৎসক নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিৎসক। তার নাম ফারজানা হোসেইন। দেশটির ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস- এনএইচএস এই ঘোষণা দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পিকাডিলি সার্কাসের সামনের তাকে নিয়ে বিলবোর্ড টাঙানো হয়েছে। ব্রিটেনের সাটারস্টক ডটকম ছবিটি প্রকাশ করেছে।
এতে দেখা যাচ্ছে, বিলবোর্ডটির সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ফারজানা হোসেইন। ডা. ফারজানা হোসেইন এবং তার টিম করোনা মহামারীকালীন ব্রিটেনের রোগীদের চিকিৎসা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ডা. ফারজানা হোসেইন ১৮ বছর ধরে পূর্ব লন্ডনে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত।
ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ইস্টার্ন আই-এ এক সাক্ষাৎকারে জীবনগাথা তুলে ধরেছেন ফারজানা।
ফারজানার জীবনের অজানা গল্প
বাবা ছিলেন অ্যানেস্থেসিয়া স্পেশালিস্ট। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে হাসপাতালে যেতেন, তখন ডাক্তার আঙ্কেল ও নার্স আন্টিরা তাকে চকলেট খেতে দিতেন, সবাই ভীষণ আদর করতেন তাকে।
বছর পাঁচেকের ছোট্ট মেয়েটা তখনই নিজের জীবনের গতিপথ ঠিক করে নিয়েছিল- বড় হয়ে ডাক্তার হবে।
মধ্য চল্লিশে দাঁড়িয়ে ফারজানা হুসেইন নামের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সেই নারী এখন চিকিৎসক। ব্রিটেনের সেরা জেনারেল প্র্যাকটিশনার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাসের বিলবোর্ডে ঠাঁই হয়েছে তার ছবি। যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর চিকিৎসাসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে সেরাদের সেরা নির্বাচন করা হয়।
কর্মক্ষেত্রে সারা বছরের কাজের ভিত্তিতে করা হয় এই মূল্যায়ন। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের অজস্র কর্মীকে (ডাক্তার-নার্স) পেছনে ফেলে নিজের কর্মদক্ষতায় গত বছরের সেরা জেনারেল প্র্যাকটিশনার নির্বাচিত হয়েছেন ফারজানা।
ফারজানার বাবা-মা দু’জনই ছিলেন বাংলাদেশি। বাবা ১৯৭০ সালে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে গিয়েছিলেন যুক্তরাজ্যে, পরে সেখানেই থিতু হয়েছেন। ফারজানা পড়েছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলসের স্কুল অব মেডিসিনে।
তিনি বলেন, ডাক্তারি পেশাটার প্রতি ফারজানার অন্যরকম ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল মায়ের কারণে। আমি মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্রী, মা তখন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন।
সারা সপ্তাহ ক্লাস করে সপ্তাহান্তে ছুটে যেতাম ২৫০ কিলোমিটার দূরে, যে হাসপাতালে মা ভর্তি আছেন। রুটিনের মতো হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। ফারজানা আরও বলেন, একবার মা প্রচণ্ড অসুস্থ।
শরীর ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরদিন গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাস ছিল। মাকে রেখে ক্যাম্পাসে ফিরে যাব কি যাব না- এই দোটানায় ভুগছিলাম। তখন মা-ই জোর করে ফেরত পাঠালেন, বললেন, তুমি কলেজে ফিরে যাও।
আমি চাই আমার মেয়ে বড় ডাক্তার হবে, মানুষের সেবা করবে। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, আমি ঠিক হয়ে যাব।’ তার পাঁচ দিন বাদে মা মারা গিয়েছিলেন, জীবিত অবস্থায় মাকে আর দেখতে পাননি ফারজানা।
তবে মায়ের শেষ কথাগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল তার। বড় ডাক্তার হতে হবে, মানুষের সেবা করতে হবে। গত দুই যুগ ধরে সেই মিশনেই ছুটে চলেছেন ফারজানা হুসেইন। পথচলাটা বন্ধুর ছিল। ফারজানা হার মানেননি কখনও।
তিনি বলেন, ‘যখনই হতাশা আঁকড়ে ধরেছে, তখন মায়ের কথা স্মরণ করেছেন, ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে, অদ্ভুত একটা শক্তি এসে জড়ো হয়েছে মনের ভেতর।’ প্রায় ১৮ বছর ধরে ইংল্যান্ডের নিউহ্যাম শহরে পটার জোনাস নামের এক সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে মিলে প্রোজেক্ট সার্জারি নামের একটা মিশন চালাচ্ছেন ফারজানা ও তার টিম।
২০০৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫০০ রোগীকে সেবা দিয়েছেন তারা। পিটার ছিলেন তার সবচেয়ে বড় মেন্টর। ছয় বছর আগে পিটার মারা যাওয়ার পরে পুরো কাজের ভার এসে পড়েছিল ফারজানার কাঁধে।
নিজে বাংলাদেশি হওয়ায় মাইগ্রেন্ট পেশেন্টদের সঙ্গে আন্তরিক হয়ে মিশতে পারেন ফারজানা, যেটা স্থানীয় অনেক চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব হয় না।
নিজের কাজটাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন ফারজানা, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়ার সামর্থ্য তাকে দেয়া হয়েছে, সেই দায়িত্বটা যথাযথভাবে পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা তিনি করেন। রোগীদের সঙ্গে তিনি নিজের পরিবারের সদস্যদের মতোই ব্যবহার করেন। তিনি মনে করেন- এই মানুষগুলোও কারও না কারও প্রিয়জন।