রহিদুল ইসলাম রাইপ, নওগাঁ প্রতিনিধিঃ নওগাঁর ছোট যমুনা ও আত্রাই নদীর পানি কমতে শুরু করায় নওগাঁয় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে ছোট যমুনাও আত্রাই নদীর পানি সকল পয়েন্টে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বাঁধের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ করায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকার নিম্মাঞ্চলগুলো প্লাবিত হচ্ছে। তবে ভেঙ্গে যাওয়া নদীর বেড়িবাঁধগুলো ভালো ভাবে মানসম্মত মেরামত না করার কারণে প্রতিবছরই হাজার হাজার মানুষ বন্যার ক্ষতির সম্মুখিন হয়ে আসছে। তাই বাঁধগুলো স্থায়ীভাবে মেরামত ও সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন বানভাসীরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের আত্রাই নদীর ৪টি পয়েন্টে, আত্রাই উপজেলায় ২টি সড়ক ও ছোট যমুনা নদীর বেড়িবাঁধের কয়েকটি জায়গায় ভেঙ্গে জেলার রাণীনগর, আত্রাই ও মান্দা উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে এই তিন উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। এসব এলাকার প্রায় ৪হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে শত শত পুকুরের কোটি টাকার মাছ।
বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ এখন উঁচু স্থানে, সড়ক, বেড়িবাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। আবার কেউ পানিতে নিমজ্জিত বাড়ির পাশেই নৌকায় অবস্থান করছেন। এসব এলাকায় এখন বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবারসহ গবাদি পশুর খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে নানা রকমের পানিবাহিত রোগ। এদিকে বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে নওগাঁর মান্দা-আত্রাই, বান্দাইখাড়া-আত্রাই, নাটোর-সিংড়া-আত্রাই আঞ্চলিক সড়কের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বন্যাকবলিত রাণীনগর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের রহিম উদ্দিনসহ অনেকেই জানান, তাদের কাছে এখনো সরকারি কোন ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। একদিকে করোনা ভাইরাসে কর্মহীন অপরদিকে বন্যার থাবায় বাড়ি-ঘর ছেড়ে রাস্তায় বসবাস। নেই কোন খাবার উপকরণ। এখন আমরা কোথায় যাবো। কি খেয়ে বাঁচবো।
মান্দা উপজেলার বাঁধে আশ্রয় নেওয়া বানভাসীদের অনেকেই জানান, ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধের অংশ ভালোভাবে মেরামত না করার কারণে প্রতিবছরই আমরা বন্যার শিকার হয়ে আসছি। তাতে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। কারণ বন্যার সময় বাড়ি-ঘর ছেড়ে বাঁধের উচু স্থানে এসে থাকতে হয় আমাদের। কোন অফিসাররা এসে আমাদের সঙ্গে থাকে না। সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ খাবার সামগ্রী দেওয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের চাইতে অনেক কম। আমরা খাবার চাই না। আমরা চাই ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধটি এমন ভাবে মেরামত করা হোক যেন নদীতে পানি এলে ভেঙ্গে যাওয়ার ভয় থাকে না আর আমাদের বন্যার কারণে ঘর-বাড়ি ছাড়তে না হয়।
আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছানাউল্লাহ বলেন, আত্রাই উপজেলার জাতআমরুল এবং বৈঠাখালি নামকস্থানে বাঁধ ভেঙ্গে পাচুপর, আহসানগঞ্জ, কালিকাপুর, হাটকালুপাড়া ও ভোপাড়া ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিতসহ ৫টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়েছে। দ্রুত ৫টি ইউনিয়নের প্রায় ৬০টি গ্রামে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ২হাজার পরিবারের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে শুকনা খাবার এবং চাল বিতরণ করা হয়েছে। আহসানগঞ্জ মেমোরিয়াল একাডেমিতে ৫০/৬০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল হালিম বলেন, আত্রাই নদীর কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় উপজেলার কশব, নুরুল্লাহবাদ ও বিষ্ণপুর ৩টি ইউনিয়নের কমপক্ষে ৪০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদের অনেকেই নদীর বাঁধসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। এই ৩টি ইউনিয়নের প্রায় ২০হাজারেরও বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই উপজেলায় তাৎক্ষণিকভাবে ৫০০পরিবারের মধ্যে শুকনা খাবার এবং চাল বিতরণ করা হয়েছে। এই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে বলেও তিনি জানান।
রাণীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আল মামুন বলেন, ছোট যমুনা নদীর নান্দাইবাড়ি-কৃষ্ণপুর-মালঞ্চি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে কয়েকটি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দ্রুত তাদের মাঝে সরকারি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হবে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, গত ৩দিনে জেলায় ৩ হাজার ৮৪৮হেক্টর জমির ধান ও শাকসবজি নিমজ্জিত হয়েছে। এপর্যন্ত ৩১৩৪ হেক্টর আউশ, ৩৭৬ হেক্টর রোপা আমনের বীজতলা, ২০০ হেক্টর বপন করা আমন, ৫০হেক্টর রোপনকৃত আমন, ১১ হেক্টর মরিচ, ১৫৪ হেক্টর সবজি এবং ৭৭ হেক্টর পাটসহ সর্বমোট ৩৮৪৮ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু নদীর পানি কমতে শুরু করেছে এতে পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমান অনেকাংশে কমে আসবে।
নওগাঁ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ জানান, উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে আত্রাই নদী, ফকিন্নী ও ছোট যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে তিন উপজেলার ২৪২টি পুকুরের ৬৮ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩কোটি ৪২লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডর নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খাঁন বলেন, বৃহস্পতিবার থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তাই বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে আর যদি বৃষ্টিপাত না হয় ও উজান থেকে পানি তেমন একটা নেমে না আসে তাহলে নওগাঁতে নতুন করে বন্যার আর কোন আশঙ্কা নেই। তবে আবার নতুন করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ বলেন, ইতিমধ্যেই মান্দার বন্যাকবলিত কিছু এলাকা পরিদর্শন করেছি। বানভাসী মানুষের সাথে কথা বলেছি। তাদের বিভিন্ন সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানের ব্যবস্থা করেছি। সহস্রাধিক বানভাসী মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী হিসেবে ১০কেজি করে চাল, চিড়া, স্যালাইনের প্যাকেট বিতরণ করেছি। এছাড়াও বানভাসী মানুষের বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল, ভ্রাম্যমাণ ল্যাট্টিন ও স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা করেছি। তিনি আরও জানান, বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে ১৩৫মেট্টিক টন চাল ও ২ লাখ ২হাজার ৫শত নগদ টাকা ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২১৫মেট্টিক টন চাল, ২হাজার শুকনো খাবার প্যাকেট, নগদ ২লাখ ৯৮হাজার টাকা, শিশু খাদ্যের জন্য ২লাখ টাকা ও গো-খাদ্যের জন্য ২লাখ টাকা মজুদ রয়েছে।