রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্গম সাজেক পাহাড়ে কাটছে আঁধার

ডেস্ক নিউজ : ‘হিং দি থাংলাইন অ সাজেকনি হা তা’—এটা আবার কোন ভাষা? এই প্রশ্নে রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেকের রুইলুই পাড়ার সাজেক রিসোর্টের এক কর্মী বললেন, ‘এটা আমাদের ত্রিপুরা ভাষা।’ কথাটির অর্থ, ‘চল যাই সাজেক রাজ্যে।’ ওই কর্মীর কথায় জানা গেল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত ওই রিসোর্টে কর্মসংস্থান হয়েছে স্থানীয় লোকজনেরও। একই স্থানে ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠীর কুসুমবালাদের ছোট বাসাটির ওপরের অংশ ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে তিন কক্ষের একটি আবাসিক হোটেল। নাম ‘টংথক রিসোর্ট’। রিসোর্টের পেছনে যতদূর চোখ যায় সবুজ পাহাড়ের সারি আর সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। কাছেই ভারতের মিজোরাম সীমান্ত। মাঝে সাজেক নামের ছোট একটি নদী। সেই নাম থেকেই ভ্রমণপিয়াসীদের মন কেড়ে নেওয়া আজকের ‘সাজেক’।

টংথক রিসোর্টের ব্যবস্থাপক জসিমউদ্দিন জানান, তিন বছর আগে রিসোর্টটি গড়ে ওঠে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিসোর্টের কোনো কক্ষ খালি থাকে না। জায়গার মালিককে বছরে দুই লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে এটি চলছে।

কুসুমবালা বললেন, ‘এখন আমরা ভালো আছি। আয় বেড়েছে। আগে নিজেদের এই সামান্য জায়গা ভাড়া দিয়ে এত টাকা পাওয়া যাবে ভাবতেই পারিনি।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, একসময়ের দুর্গম সাজেক এখন সুগম হয়েছে সেনাবাহিনীর তৈরি রাস্তার কল্যাণে। পাহাড়ের খাদের কিনার দিয়ে এ রাস্তা নির্মাণও ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সেই সময় ওই রাস্তাটি নির্মাণে বাদ সাধে পাহাড়ের দুই আঞ্চলিক সংগঠন; এখন যেমন বিরোধিতা করা হচ্ছে বান্দরবানে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের ক্ষেত্রে। বান্দরবানে হোটেলটির জন্য যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার চেয়ে ২০ গুণ বেশি বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।

সাজেকের এক লুসাই নেতা জানান, এখনো প্রতিদিন সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে এখানে পর্যটক আসছে। পাহাড়িদের একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এখনো এটি বন্ধ করার সুযোগ খুঁজছে।

সাজেকের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় কংলাকে পৌঁছে দেখা হয় লুসাইদের অন্যতম নেতা ও সাজেক ইউনিয়নের সাবেক সদস্য লাল তনার সঙ্গে। দুপুরের দিকে তিনি ওই পাহাড়ের চূড়ায় ব্যাপটিস্ট চার্চের বার্ষিক পরিকল্পনাসভায় সভাপতিত্ব করছিলেন। পরে লাল তনার সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। মোবাইল অপারেটর রবির নেটওয়ার্ক সাজেকে সচল। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ১৩ বছর আগে দেখা হওয়ার স্মৃতিচারণা করে বললেন, ‘দেখেই তো গেলেন পরিবেশ কেমন পাল্টে গেছে। আমরা এখন ভালো আছি। এখানে পর্যটন শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হচ্ছি। স্থানীয় শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। কংলাক পর্যন্ত রাস্তা  তৈরির কাজ দ্রুত শেষ হবে বলে শুনছি। এটা আমাদের জন্য আরো একটি পাওয়া। তবে অনেক ভালো কিছু পেতে হলে খারাপও কিছুটা নিতে হয়। আমাদের গ্রামের ওপর গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র। স্বাভাবিকভাবে বাইরের অনেক লোক আসছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এটা যেন ঘনবসতি হিসেবে গড়ে না ওঠে, সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি দরকার।’

কংলাকে যাওয়ার পথে গোবিন্দ ত্রিপুরা নামের এক কিশোর বাঁশের লাঠি বিক্রি করছিল। সমুদ্র পিষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ৪০০ ফুট উঁচু কংলাক পাহাড়ে ওঠার বিপজ্জনক পথ পেরুতে এই লাঠি খুবই প্রয়োজনীয়। গোবিন্দ জানায়, প্রতিদিন তাঁর শতাধিক লাঠি বিক্রি হয়। পাহাড় থেকে সংগ্রহ করা একেকটি লাঠি বিক্রি হয় ১০ টাকা করে।

একই পথের ধারে বাঁশের চোঙ্গায় করে চা বিক্রি করছিলেন পোলেন ত্রিপুরা ও তাঁর স্ত্রী পেঞ্জু ত্রিপুরা।  প্রতি কাপ ২০ টাকা। তাঁদের  কাছে দুধ চা ও তেঁতুল চায়ের ব্যবস্থা আছে। জুম চাষের পাশাপাশি পর্যটন শিল্প তাঁদের এই বাড়তি আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে। ওই চায়ের দোকানে পাদিং লুসাই নামে আরেক যুবক জানান, সাজেকে হলুদ আর জুম চাষের মাধ্যমে ধানের উৎপাদনই ছিল জীবিকার প্রধান অবলম্বন। এখন নানাভাবেই টাকা আসছে।

দিঘিনালার যুবক নরুল ইসলাম সাজেকে মোটরসাইকেলে করে অনেক পর্যটককে কংলাক পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছে দিচ্ছিলেন। তাঁর কাছে জানা গেল, সাজেকে এখন দুই শর বেশি মোটরসাইকেল রাইডার কর্মরত। রুইলুই পাড়ার লুসাই কটেজের ব্যবস্থাপক মাহমুদুল হাসান জানান, সাজেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ গাড়ি আসছে। সমিতিভুক্ত আবাসিক হোটেল বা কটেজের সংখ্যা ১২০টি। নতুন আরো কয়েকটি হচ্ছে।

পিকআপ চালক মির হোসেন বললেন, ‘খাগড়াছড়ির জিপ মালিক সমিতির প্রায় ৫০০ গাড়ি এখন প্রতিদিন সাজেকে যাওয়া-আসা করছে। ভাড়া সাত হাজার ৭০০ টাকা থেকে ৯ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত।’

সাজেক রাঙামাটির বাঘাইছড়ির একটি ইউনিয়ন হলেও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কারণে এখানে পর্যটন শিল্পের বিকাশে বেশি সুবিধা পাচ্ছে খাগড়াছড়ি। খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বললেন, ‘এখন গ্রাম থেকেও মানুষ আসছে খাড়াছড়ির বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র আর আর সাজেক দেখতে। আলুটিলা গুহা দেখতে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ৮০০ পর্যটক আসে। সাজেক রাঙামাটির হলেও পর্যটক যাচ্ছে আমাদের জেলা দিয়ে। খাগড়াছড়ি থেকেই সেখানে খাবার যাচ্ছে।’

খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল আজিজ বলেন, ‘প্রতি রাতেই ৫০-৬০টা করে ট্যুরিস্ট বাস আসছে খাগড়াছড়িতে। সাজেকে যারা যাচ্ছে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

এই বিভাগের আরো খবর