মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাদেনের ‘স্লো পয়জন’, একটি সংগঠন এবং একজন ইমরান খান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার মাস্টারমাইন্ড ওসামা বিন লাদেনকে ‘শহিদ’ বলে মন্তব্য করে বিতর্কে জড়িয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। সমালোচনায় সরব হয়েছেন বিরোধীরাও। যেহেতু দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ওসামা বিন লাদেনকে শহিদ হিসেবে স্মরণ করেন, তাই এই ‘পবিত্র’ সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা প্রাসঙ্গিক। ওসামা বিন লাদেনের সিরিয়ান মা হলেন তার কোটিপতি ইয়েমেনি বাবার বহু স্ত্রীর মধ্যে অন্যতম। তার ভাইয়েরা যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য পাশ্চাত্যে যাওয়া শুরু করলেন, তখন ওসামা জেদ্দার আবদেল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াটাকেই গুরুত্ব দিলেন। যেখানে ওসামার ইসলামিক বিষয়ে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। দু’জন ক্যারিশম্যাটিক শিক্ষক, মুহাম্মদ কুতুব ও আবদুল্লাহ আজম দ্বারা তিনি ব্যাপকভাবে উত্সাহিত হন। মুহাম্মদ কুতুব হলেন মিশরের ইখওয়ানের (ইখওয়ান ছিল একটি ওয়াহাবি মিলিশিয়া দল) বিখ্যাত নেতা সৈয়দ কুতুবের ভাই। আর আবদুল্লাহ আজম হলেন একজন ফিলিস্তিনি। তিনি জাহিলিয়ার ‘কুতুব মতবাদ’কে একীভূত করেছিলেন। তিনি পশ্চিমদের বিরুদ্ধে আধুনিক জিহাদও গড়ে তুলেন।

ওসামা ১৯৮০ সালের দিকে পেশোয়ারে আসেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য। ১৯৮৪ সালের মধ্যে ওসামা পেশোয়ারে অনেক সময় কাটান। তিনি শহরের বেশ কয়েকটি গেস্ট হাউস ভাড়া নিয়েছিলেন এবং আল-জিহাদ পত্রিকা অফিস যাওয়া শুরু করেন। আল-জিহাদ পত্রিকা মূলত আরবি ভাষায় পেশোয়ার থেকে প্রকাশিত হত। পত্রিকাটির পরামর্শদাতা ছিলেন আজম (পরবর্তীতে আজম পাকিস্তানের ইসলামাবাদে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধুমাত্র চরমপন্থাই ছড়িয়েছে।) ১৯৮৯ সালে জালালাবাদে মুজাহিদিনরা পরাজয়ের বরণ করে। তখন সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে ওসামার জিহাদ কিছুটা ধাক্কা খায়। ১৯৯১ সালের দিকে ওসামা চিন্তা করলেন তার আসল ‍শত্রু হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর তার এই টোপটি ভালোভাবেই গিলে পাকিস্তান। আফগানিস্তানের প্রশিক্ষণ শিবিরে শুরু হওয়া সন্ত্রাসবাদের জন্য সিপাহ সাহাবাকে (পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল, বর্তমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত নামে পরিচিত) দায়ী করেন বিখ্যাত সাংবাদিক জ্যাসোন বুরকে। তিনি দাবি করেন, বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করার জন্য একটি পরিকল্পনা করেন রামজি ইউসুফ। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। তবে একটা বড় উসকানি তিনিই দেন। আর তার এ কাজের জন্য সকল অর্থ আসত রামজির আত্মীয় খালিদ শেখ মোহাম্মদের কাছ থেকে। মোহাম্মদ তখন করাচিতে সৌদি ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে বাস করছিলেন। আর ৯/১১ হামলার পরিকল্পনা করছিলেন।

এদিকে, আবার রামজি ইউসুফ ভুট্টোর করাচির বাড়ির বাইরে আহত হয়ে পড়েন। তার বোমাটি আকালে ফেটে যাওয়ায় তিনি আহত হন। গুরুতরভাবে আহত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর হাসপাতালে তাকে দেখতে আসেন সিপাহ সাহাবার ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতারা। এই হামলার জন্য তখন ভুট্টো সরকার লাদেনকে দায়ী করে। এরপর আর কিছুই হয়নি। অন্যদিকে, খালিদ শেখ মোহাম্মদ নিউইয়র্কে হামলার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। এক সময় প্রকাশ্যে আসে যে, ওসামাকে অর্থায়নের জন্য নতুন পরিকল্পনা দেওয়ার আগে পুরো আরবের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আফগানিস্তানে চলে যায়। তারা দেশটিতে অভিবাসী হিসেবে বা তীর্থযাত্রী হিসেবে যান। আফগানিস্তানে যারা ছিলেন তাদের মাধ্যে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ান হাম্বলিও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিনিদের হত্যা করার প্রজেক্টে অর্থ ঢালার জন্য প্রায়ই তিনি আয়মান আল-জাওয়াহিরির সঙ্গে দেখা করতেন। তাকেই প্রায়ই করাচিতে দেখা যেতো। ১৯৯৬ সালের দিকে কানাডা, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে আরব প্রবাসীরা পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তান যান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল লাদেনের কাছে বায়াত গ্রহণ করা। সৌদি তরুণরা, যাদের বেশিরভাগই মূলত ইয়েমেনের বাসিন্দা; ধীরে ধীরে অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি এসেছিলেন আফগানিস্তানে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র তাদের অন্য দেশের তুলনায় আরো সহজে ভিসা দিয়েছে।

ওসামার কাজে সহযোগিতা করতেন আরো এক মিশরের নাগরিক। তিনি হলেন আবু জুবায়দা। তিনি অতি শিগগিরই আল কায়েদার মৌলিক সম্পদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ওসামা সুদানে থাকেন। এ সময় প্রশিক্ষণ দেখাভাল করার জন্য তিনি পেশোয়ারে ফিরে আসেন। তারপর তাকে গুলি করার পর যখন আটক করা হয়, তখন পাকিস্তানের কেউই জানতেন না যে বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। করাচিতে রামজি বিন আল-সিভ নামের আরো একজনকে আটক করা হয়। তিনি ছিলেন ‘হামবার্গ সেল’ নামের একটি সংগঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আসলে বিষয়গুলো ছিল চিন্তারও বাইরে। ইসলামাবাদের সরকার যদি তার সম্পর্কে জানত; তবে বিষয়টি এ রকম যে, না জানার ভান করে থাকা। ২০০১ সালের ১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে হানা দেয় আল-কায়দা। এরপর ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদ শহরে লাদনকে হত্যা করে মার্কিনিরা। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে প্রায় ১৩টি দল তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) গঠনে বায়তুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে এক হয়। তেহরিক-ই-তালিবানের বেশ কয়েকটির উদ্দেশ্যর মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলা। টিটিপি’র মূল লক্ষ্য হলো পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী অভিযান চালিয়ে দেশটির সরকারকে উৎখাত করা।

সাধারণত টিটিপি আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের উপজাতি বলয়ের ওপর নির্ভর করে। সেখানে থেকেই তারা লোকবল নিয়োগ দেয়। টিটিপি আল-কায়দার কাছ থেকে আদর্শিক দিক-নির্দেশনা পায়। আর আল-কায়দার সঙ্গে মধুর সম্পর্কও বজায় রেখে চলে সংগঠনটি। ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বিবিসি এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, পাকিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে পাঁচ সদস্যের একটি দল ঘোষণা করেছে। তাদের একজন হচ্ছেন রাজনীতিবিদ ও প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খান।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

এই বিভাগের আরো খবর