বৃহস্পতিবার, ২৬শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রবাসী নারীর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে স্বামীকে ভুয়া তালাকের অভিযোগ

রহিদুল ইসলাম রাইপ, নওগাঁ প্রতিনিধিঃ নওগাঁর রাণীনগরে কাজীর বিরুদ্ধে প্রবাসী নারীর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে স্বামী তালাকের এফিডেভিট তৈরি ও তালকের নোটিশ দিয়ে সাজানো সংসার তছনছ করার অভিযোগ উঠেছে।

বিষয়টি বেশকিছুদিন পর জানাজানি হলেও দায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে কাজী ওই তালাক ভুয়া ও জাল বলে প্রত্যয়ন দেওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় চলছে।

এদিকে নওগাঁ কাজী সমিতি প্রশ্ন তুলেছে, তালাকটিই তো সম্পূর্ণ অবৈধ সেটির আবার প্রত্যয়নপত্র দেয় কিভাবে?

অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে, রাণীনগর উপজেলার কাচারী বেলঘড়িয়া গ্রামের দিনমজুর আজিজুল কাজীর মেয়ে মোছা: রাহিমা বিবির সাথে প্রায় ১৪ বছর আগে একই এলাকার রঞ্জনিয়া (পূর্বে কাশিমপুর গ্রাম) গ্রামের মোঃ আব্দুল জব্বার মন্ডলের ছেলে মোঃ মোতালেব মন্ডলের বিয়ে হয়। দম্পতিদের ঘড়ে ৯ বছরের এক ছেলে আছে। অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় প্রায় ৬ বছর আগে বিদেশ (জর্ডান) পাড়ি জমান রাহিমা বিবি। এরপর থেকে তাদের সংসার ভালোই চলছিলো। রাহিমার পাঠানো অর্থ দিয়ে স্বামী মোতালেব জমিজমা কেনাসহ সংসারের ঋণগুলো পরিশোধ করেন। এদিকে নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী বেলাল হোসেন প্রবাসী রাহিমা বিবির স্বাক্ষর জালিয়াতি করে গত বছরের ১৯ এপ্রিল নওগাঁ নোটারি পাবলিক কার্যালয় থেকে স্বামী তালাকের জন্য এফিডেভিট সৃষ্টি করে।
পরে একইদিন মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭(১) ধারা মোতাবেক স্বামী তালাকের নোটিশ এক কপি স্বামী মোতালেব কে এবং এক কপি রাহিমার বাবার বাড়ি দিয়ে আসে।

মেয়ে প্রবাসে জীবন-যাপন করছে অথচ এফিডেভিট করে স্বামী তালাকের এমন নোটিশ পেয়ে হতভম্ব হয় রাহিমার পরিবার।

বিষয়টি জানাজানি হলে নিজেকে বাঁচাতে গত ৯ আগস্ট মোঃ বেলাল হোসেন নিজেকে নিকাহ রেজিস্ট্রার (কাজী) পরিচয় দিয়ে স্বাক্ষর ও সিল মোহরযুক্ত একটি প্রত্যয়ন নিজেই প্রবাসী রাহিমার মায়ের নিকট পৌঁছে দেয়। প্রত্যয়ন পত্রে লেখা হয় “এই তালাক আমার অফিসে হয় নাই বা তালাক করে নাই ইহা সত্য। যদি কেউ তালাকের কাগজ দেখিয়া থাকে বা কেউ তৈরী করিয়া থাকে তাহা জাল ও ভুয়া এবং মোছা: রাহিমার ক্ষতি সাধনের জন্য করিয়াছে। যাহা উদ্দেশ্য প্রণোদিত”।

রাহিমার মা আফরোজা বিবি বলেন, আমরা মূর্খ ও গরীব মানুষ। কাগজপত্র সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝি না। রাহিমা আমাকে বলেছে সে স্বামী তালাক করে নাই। তাহলে কাজী বেলাল হোসেন কিভাবে স্বামী তালাকের কাগজ তৈরি করে আমাদের কাছে দিলো। আজ এই ভুয়া কাগজের জন্যই আমার মেয়ের নিজ হাতে গড়ে তোলা কষ্টের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো।

আমার জামাই ওই কাগজের ভিত্তিতে আবার বিয়ে করলে মেয়ের পাঠানো টাকায় কেনা জমির ভাগাভাগি করার জন্য থানায় একটি অভিযোগ দেই। পরে সেটা নিয়ে আলোচনার সময় বেরিয়ে আসে জালিয়াতি করে দেওয়া মিথ্যে তালাকের কাহিনী। আজ কাজী বেলালের কারণেই আমার মেয়ের সংসার নষ্ট হয়ে গেছে। আমি কাজীসহ এর সঙ্গে জড়িত অন্যদের কঠোর শাস্তি চাই।

রাহিমার সাবেক স্বামী ভটভটি চালক মোতালেব হোসেন বলেন, মাঝখানে রাহিমার সঙ্গে আমার একটু মনমালিন্য চলছিলো। কিছুদিন পর আমার পাশের বাড়িতে কাজী বেলাল নিজে এসে তালাকের কাগজপত্র দিয়ে যায়। পরে বেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে বলে তালাকের পর ৩ মাস পার হয়ে গেছে, এখন বিয়ে করতে পারবে। কারণ রাহিমা যখন আমাকে তালাক দিয়েছে আমাকে তো আমার সংসার ধরে রাখার জন্য আরেকটি বিয়ে করতে হবে। তাই আমি কাজীর পরামর্শে আরেকটি বিয়ে করেছি।

কাজী পরিচয়দানকারী মো: বেলাল হোসেন বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তালাকের নোটিশ ফরম ও প্রত্যয়নপত্রে স্বাক্ষর ও সিল দেওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন এই বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দিতে রাজি নন।

উপজেলা মুসলিম পারিবারিক ও নিকাহ রেজিস্ট্রার এবং কাজী সমিতির সভাপতি এটিএম রেজাউল করিম বলেন, আমাদের কাছে থাকা সরকারি বইয়ে মোঃ বেলাল হোসেন নামে তালিকভুক্ত কোন কাজীর নাম নেই। কাজী না হয়েও বেলাল কতিপয় প্রভাবশালী মহলের প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন যাবত অবৈধ কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সে শুধু রাণীনগর উপজেলাতেই নয় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বয়স বৃদ্ধি করে বাল্য বিয়ে, দেনমোহর জালিয়াতি, মিথ্যে তালাক দেয়াসহ ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে অবৈধ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। তার ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে অনেক পরিবার। বিগত সময়ে তার এই সব অবৈধ কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কাজী সমিতির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকসহ উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ দিলে তা রহস্যজনক কারণে আর আলোর মুখ দেখে না।
তবে এই ভুয়া কাজী বেলালের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।

নওগাঁ জেলা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট ডিএম আব্দুল বারী বলেন, এফিডেভিটের মাধ্যমে তালাক হয় না। বাংলাদেশ সরকার বিদেশে অবস্থান করে তালাক দেওয়ার কোন বৈধতা দেয়নি। যদি কেউ বিদেশে অবস্থান করে তালাক দেয় তাহলে সেটা সম্পন্ন ভুয়া ও মিথ্যে। এই সব ভুয়া কাজের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুযোগ আছে।

উল্লেখ্য যে, গত বছর বাল্যবিবাহ ও দেনমোহর জালিয়াতির ঘটনায় একটি মামলার তদন্ত শেষে নওগাঁ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরির্দশক শফিকুল ইসলাম এই ভুয়া কাজীকে অভিযুক্ত করে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন (মামলা নং সি.আর মামলা নং-০১/১৯(রাণীনগর),ধারা-৪৬৪/৪৬৫/৪৬৮/৪৭১ পেনাল কোড)।

এই বিভাগের আরো খবর