আরবী ভাষায় ‘হজ্জ’ অর্থ জিয়ারতের সংকল্প করা। যেহেতু খানায়ে কা’বা জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মুসলমানগণ পৃথিবীর চারদিক থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রের দিকে চলে আসে, তাই এর নাম রাখা হয়েছে ‘হজ্জ’।
ইসলামে হজ্জ একটি আবশ্যকীয় বা ফরজ উপাসনা। এটি ইসলামের ৫ম স্তম্ভ। হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ “ইচ্ছা” বা “সংকল্প” করা। আচার ও আদব-কায়দার বিবেচনায় হজ্জ হলো হিজরি (চান্দ্র বৎসর) সনের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট পোশাকে কয়েকটি স্থানে অবস্থান বা ওকুফ, ক্বাবা শরীফের তাওয়াফ, পশু কোরবানি, নির্দিষ্ট স্থানে পরপর ৩দিন কংকর নিক্ষেপ এবং সাফা-মারওয়া টিলাদ্বয়ের মধ্যে হাঁটা।
আবু হোরায়রা বর্ণিত এক হাদিসে ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্জ করে এবং অশ্লীল ও গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকে সে হজ্জ থেকে এমতাবস্থায় ফিরে আসে যেন আজই মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। অর্থাৎ জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, সেও তদ্রূপই হয়ে যায়।” আরেকটি হাদিসে তিনি বলেছেন- ‘শয়তান আরাফার দিন হতে অধিক লজ্জিত ও অপদস্থ আর কোনো দিন হয় না, কেননা ওই দিন আল্লাহতায়ালা স্বীয় বান্দার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করেন ও অসংখ্য কবিরা গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’ তিনি আরও বলেছেন- ‘একটি বিশুদ্ধ ও মকবুল হজ্জ সমগ্র পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর চেয়ে উত্তম। বেহেস্ত ব্যতীত অন্য কোনো বস্তু তার প্রতিদান হতে পারে না।”
হজ্জের ঐতিহাসিক পটভূমি কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ্জ আদায় করেন ইসলামের নবী হজরত আদম অোঃ)। তারপর হজরত নূহ(আঃ)সহ ইসলামের অন্যান্য নবী-রাসূল এ দায়িত্ব পালন করেন। ইব্রাহিম (আঃ) এর সময় থেকে হজ্জকে ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত করা হয়। হিজরি সনের ১২তম মাস হলো জিলহজ্জ মাস। ইসলামের বর্ণনা অনুসারে এই সময়ই স্রষ্টা ইব্রাহিম (আঃ)কে হজ্জ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার জন্য নির্দেশ দেন।
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, এ আদেশের পর ইব্রাহিম (আঃ) আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন : লোক সকল, তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ্জ ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো”। এই বর্ণনায় আরও উল্লেখ আছে যে, ইব্রাহিম(আঃ)এর ঘোষণা স্রষ্টার পক্ষ থেকে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়।
হজ্জের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান(আরকান-আহকাম) হজরত ইব্রাহিম(আঃ) এর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিভিন্ন ইসলামিক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, হজরত ইব্রাহিম স্রষ্টার নির্দেশে তাঁর স্ত্রী বিবি হাজেরাকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। সেখানে, ক্বাবা শরীফের অদূরে, বিবি হাজেরা নবজাত শিশু ইসমাইলকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছিলেন। সাহায্যের জন্য কাউকে না পেয়ে তিনি পানির খোঁজে সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করেই হজ্জের সময় মুসলিমদের জন্য সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে হাঁটার নিয়ম রয়েছে।
ইসলামিক বর্ণনায় উল্লেখ আছে, স্রষ্টা বেহেশত বা স্বর্গ থেকে আদম ও হাওয়াকে যখন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, যাতে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে উভয়ে আরাফাত ময়দানে এসে মিলিত হন। এই ঘটনার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজ্জের একটি অংশ হিসেবে মুসলিমরা আরাফাতের ময়দানে এসে উপস্থিত হয়ে স্রষ্টার কাছে কান্নাকাটি করে ইবাদতে মগ্ন হন। হজ্জ পালনের যাদের সামর্থ্য্ রয়েছে তারা এ নেক কাজ করার মাধ্যমে অনেক সওয়াব হাসিল করতে পারে। হতে পারে জন্মের পর শিশু যেমন নিষ্পাপ থাকে, তদ্রূপই ।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে হজ্জ ও যাকাত সম্পদশালী মুসলিমের জন্য অবশ্য পালনীয় বিধান। কেউ যদি কৃপণতা করে কিংবা সময়ের দোহাই দিয়ে হজ্জ পালন না করে ইন্তেকাল করেন তাহলে সৃষ্টিকর্তার কঠিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।