ডেস্ক নিউজ : ত্যাগের মহিমায় উদযাপিত হয়েছে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আমাদের ও আপনাদের নেক আমলগুলো আল্লাহ কবুল করে নিন) স্লোগানে মুখরিত হয়েছে মুসলিম বিশ্ব। মুসলিম জীবনে ঈদ শ্রেণিভেদ ভুলে গিয়ে এক নির্মল আনন্দের নাম। কিন্তু এবারে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়েছে ভিন্ন পরিবেশে। কারণ বৈশ্বিক মহামারিতে বিধ্বস্ত সমাজজীবন। অবরুদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল। ব্যক্তি ও পারিবারের নিরাপত্তার চিন্তা ছিল সবার। এমন অভূতপূর্ব সময়েও মুসলিম জনপদগুলো ভুলে যায়নি ত্যাগের মহিমায় নিজেদের মেলে ধরতে। হাত গুটিয়ে নেয়নি গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে কোরবানির গোশত বিতরণ করে নির্মল হাসি ফোটাতে। এই সংকটকালে দেশে দেশে কোরবানি উদযাপন নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
সৌদি আরব : প্রতিবছর হজ ও কোরবানি মিলে সৌদি আরবে উৎসবের এক জমকালো আবহ তৈরি হলেও এবারের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। কঠোর বিধি-নিষেধ আর নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মাত্র এক হাজার মানুষ নিয়ে এবার পালিত হলো পবিত্র হজ। উন্মুক্ত মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি দেশটির কোথাও। মসজিদগুলোতে একসঙ্গে সর্বোচ্চ মাত্র ৫০ জন মুসল্লি নিয়ে অনেক দফায় আদায় করা হয়েছে ঈদের জামাত। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জায়গায় সীমিতসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে সম্পাদন করা হয়েছে কোরবানি। দুম্বা আর উট হচ্ছে সৌদি আরবের প্রধান কোরবানি পশু। কোরবানিতে জবেহকৃত পশুগুলো বেশির ভাগই সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রক্রিয়াকরণ শেষে গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণ করা হয়। সাধারণত সৌদি আরব নিজ দেশে কোরবানি করা বিপুলসংখ্যক পশু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের গরিব মানুষের জন্য প্রেরণ করে থাকে। চলতি বছরে আন্তর্জাতিক বিধি-নিষেধের কারণে এবার সেটির বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে।
তুরস্ক : তুরস্কে এবারের ঈদুল আজহার চিত্র ছিল একদম ভিন্ন। করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়া সোফিয়ায় দীর্ঘ ৮৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ। বিশ্ববিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন আয়া সোফিয়ায় এবারে ঈদের নামাজটি ছিল ইতিহাসের স্মরণীয় ঈদ। নামাজের জন্য মসজিদের দেওয়াল ও সেজদার স্থানে ছেটানো হয় মূল্যবান গ্রিসের স্পার্টা থেকে আনা গোলাপজল। এদিকে করোনা বিস্তাররোধে ইস্তাম্বুল সিটি কর্পোরেশন আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের নির্দেশনা দেয়। মাস্ক পরে জায়নামাজসহ নির্ধারিত স্থানে ধীরস্থির ভাবে সবাইকে উপস্থিত হতে বলা হয়। ঈদের জামাতের সময় মুসল্লিদের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে দেখা যায়।
কাতার : শিল্পোন্নত ও মুসলিম জনবসতির ক্ষুদ্রতম দেশ কাতার। করোনা বিপর্যয় ঠেকাতে এখানেও উন্মুক্ত মাঠে ঈদের জামাত আদায় করা হয়নি। মসজিদগুলোতে কঠোর নিরাপত্তাবলয় নিশ্চিত করে ঈদের জামাত আদায় করা হয়েছে। কোরবানির পশু জবাই ও প্রক্রিয়াকরণেও ছিল সর্বাত্মক সরকারি সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনা। রাজধানী দোহা, মদিনাতুল খলিফাসহ বড় শহরগুলোর বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ছিল কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। সেখানে ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছিল।
মরক্কো : আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী জিব্রাল্টার প্রণালি পর্যন্ত বিস্তৃত মুসলিম জনপদ মরক্কো। করোনা বিপর্যয়ের কারণে মারাকেশিদের ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর চিরাচরিত রীতি ঝটিকা সফর এবার খুবই সীমিত পরিসরে পালন করতে দেখা গেছে।
এ অঞ্চলের অধিবাসীদের ঈদ পালনে দেখা যায় ভিন্নতর কিছু রীতি। যেমন—তারা বিগত বছরের পশুর শিং মাথায় বেঁধে কোরবানিদাতাদের অভিবাদন জানায়। ঈদের প্রথম দিন দলবেঁধে রান্নার চুলার পাশে বসে পরিবারের সবাই একসঙ্গে খাবার গ্রহণ করে।
মিসর : দেশটিতে সাধারণ সময়ে ঈদের জামাতে মসজিদ ও ঈদগাহগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই মেলে না। তবে এবার সরকারি নির্দেশে বিগত ঈদুল ফিতরের মতোই দেশের মাত্র একটি বৃহত্ মসজিদে অনেক দফায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিসরীয়রা জিলহজের শুরু থেকেই কোরবানির উৎসবে মেতে ওঠে। বাসাবাড়ি আর শপিং মলগুলোতে শুরু হয় সাজ সাজ রব। ঈদের দিন ওরা দলবেঁধে একে অন্যের বাড়ি দাওয়াত দেয় ও নেয়।
মালয়েশিয়া : মুসলিম বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশটিতেও এবার দেখা গেছে কোরবানি উদ্যাপনের ভিন্নতর চিত্র। চলতি বছর দেশটিতে কোরবানির পশু বিপণন ও বিতরণের ক্ষেত্রে সরকারিভাবে অনলাইন শপিংয়ে সবাইকে উৎসাহিত করা হয়েছিল। জামে মসজিদগুলোতে ঈদের জামাত আদায় হয়েছে সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। সাধারণত এ দেশের মানুষ সমাজবদ্ধভাবে কোরবানি করতে পছন্দ করলেও এবার তা সম্ভব হয়নি। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জায়গায় সীমিতসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে হয়েছে কোরবানি।
ইন্দোনেশিয়া : পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসতির দেশ ইন্দোনেশিয়া। এখানেও ঈদ ও কোরবানি উদ্যাপনে পরিলক্ষিত হয়েছে করোনার প্রভাব। সমাজের সামর্থ্যবান লোকেরা কোরবানির পশু কিনে জামে মসজিদগুলোতে হস্তান্তর করে। আর ইমামরা মসজিদ কেন্দ্রিক মহল্লায় পরিবার হিসাব করে তা প্রত্যেক পরিবারে সমহারে বণ্টন করে দেন। আর সামর্থ্যবানদের সেই গোশত নিকটতম গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেও দেখা যায়।
বুলগেরিয়া : সাবেক উসমানি খেলাফতে সাম্রাজ্য বুলগেরিয়ার জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মুসলমান। দেশটিতে ঈদুল আজহায় এক দিনের সরকারি ছুটি ছিল। সরকারিভাবে কোরবানি উৎসবে কোনো বাধা না থাকলেও এখানে কট্টর খ্রিস্টানরা করোনা বির্পযয়ের নামে কিছু এলাকায় বাধা সৃষ্টি করে।
যুক্তরাজ্য : কয়েক বছর ধরে খোলা পার্কে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হলেও এবার করোনা সংকটের কারণে মসজিদগুলোতে কয়েক দফায় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সরকারিভাবে অনুমোদনপ্রাপ্ত নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখানকার মুসলমানরা কোরবানি সম্পাদন করেছে। নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে ঈদের আগেই নাম লিখিয়ে পশুর মূল্য পরিশোধ করে আসতে হয়। আর ঈদের নামাজের পর সেই প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির নামে ইসলামী রীতিতে কোরবানি করে গোশত পৌঁছে দেয়।
ইতালি : খ্রিস্টানদের স্বর্গরাজ্য ভ্যাটিকান সিটির দেশ ইতালি। কিন্তু এর পরও ইউরোপে অবস্থানরত চতুর্থ বৃহত্ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস এই দেশটিতে। মোট জনসংখ্যার ৪.৯ শতাংশ মুসলমান। ইতালির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মিলান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ৩০ মিনিট পর পর কয়েক দফায় সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় ঈদের জামাত। মুসল্লিরা দূর থেকে কুশল বিনিময় করেছে। ঈদের নামাজ শেষে মুসল্লিরা সরকার নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করেছে।