শুক্রবার, ২০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভিসা ছাড়া যেভাবে যাবেন নেপাল; হিমেল হাওয়ায় রুপালী রোদ

ডেস্ক নিউজ : হিমালয়কে কোলে নিয়ে পৃথিবীতে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে নেপাল। অপরূপ নৈসর্গিক সৈন্দর্যের লীলাভূমি নেপাল। হিমেল হাওয়ায় রোদের লীলাভূমির দেশটি ২০০৮ সালের মে মাসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে অবস্থান নেয়। হিমালয় অধ্যুষিত দক্ষিণ এশীয় দেশটির উত্তরে চীন এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশীদের জন্য নেপাল ভ্রমণে আলাদা ভিসা নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। নেপাল পৌঁছালেই পেয়ে যাবেন অন অ্যারাইভাল ভিসা। অনেক কম খরচেই দেশটিতে অনায়াসেরই ঘুরে আসতে পারবেন। মাউন্ট এভারেস্ট, শত বছরের পুরনো মন্দির, আকাশচুম্বী পর্বতমালা, জলপ্রপাত, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, বিভিন্ন উৎসব রয়েছে দেশটিতে। পৃথিবীর যেসব দেশে সহজে একা ভ্রমণ করা যায় তার মধ্যে নেপাল অন্যতম।

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাঠমুন্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট। এরপর অন এরাইভাল ভিসা নিতে হবে। এর জন্য নেপাল র্সাকভূক্ত দেশের নাগরিকদের নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত থাকার জন্য ফি নেয় না। অন এরাইভাল ভিসা নিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট সময় লাগবে। এর জন্য তেমন কোন ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় না। অন অ্যারাইভাল ভিসার জন্য দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, পেশাগত পরিচয়পত্রের অনুলিপি, নাগরিকত্ব সনদের অনুলিপি হলেই যথেষ্ট। কাঠমান্ডু ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে নির্দিষ্ট একটি ফর্ম পূরণ করলেই পাসপোর্টে সিল মেরে দেয়। মানি এনডোর্স করতে হবে দেড়-দুইশ ডলার। বাংলাদেশ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ইউএস বাংলাসহ একাধিক এয়ারলাইন ঢাকা-কাঠমান্ডু রুটে যাতায়াত করে। ভাড়া ১৭ হাজার ৫০০ থেকে ১৯ হাজার টাকা।

সারাংকোটের ভিউ পয়েন্ট থেকে ফিশ টেইল পর্বতশৃঙ্গ দর্শন করা যায়- সংগৃহীত

বাংলাদেশসহ সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য প্রতি বছর প্রথম ভিসার জন্য কোন ভিসা ফি নেয় না নেপাল সরকার। তবে একই বছরে দ্বিতীয় ভিসার জন্য ভিসা ফি লাগবে। এক বছরে দ্বিতীয়বার ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভিসা ফি-
১৫ দিনের মাল্টিপল ভিসার জন্য ২২০০ টাকা
৩০ দিনের মাল্টিপাল এন্ট্রির জন্য ৩৫০০ টাকা
এবং ৯০ দিনের মাল্টিপল এন্ট্রির জন্য ৯০০০ টাকা।

পৃথিবীর দ্বিতীয় আমাজান বলা হয়ে থাকে নেপালকে। প্রাকৃতিক দিক থেকে খুবই বিচিত্র একটি দেশ। এখানে রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। নেপাল আরেকটা কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো নেপালের লুম্বিনিতে জন্মেছিলেন বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ।

নেপালের মূল ভূখণ্ড ১,৪৭,১৮১ বর্গ কিলোমিটার। কাঠমুন্ডু দেশটির রাজধানী। প্রায় আড়াই কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৮১ শতাংশ হিন্দু, ৯ শতাংশ বৌদ্ধ, ৪ শতাংশ মুসলিম এবং ৬ শতাংশ অন্যান্য ধর্মালম্বী। মূদ্রা নেপালি রুপি। দেশটি ১৪টি প্রশাসনিক অঞ্চল ও ৭৫টি জেলায় বিভক্ত। বিশ্বে একমাত্র নেপালের পতাকা ত্রিভুজাকৃতির। এর রক্তিম বর্ণ নেপালের জাতীয় ফুল ‘রডোডেনড্রন’ ফুলের প্রতীক। ভূমিকম্প প্রবণ দেশটির নিজস্ব কোনো সমুদ্রবন্দর না থাকায় তারা ভারতের কলকাতা বন্দর ব্যবহার করে।

নেপালের জাতীয় ফুল ‘রডোডেনড্রন’- সংগৃহীত

নেপালের অর্থনীতি মূলত পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বের পর্বতারোহীদের পছন্দের দেশ নেপাল। অন্নপূর্না কিংবা এভারেস্টে জয়ের জন্য সারা বছরই তারা এখানে ভিড় করেন। এছাড়াও এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য, খাবার যে কোনো পর্যটককেই মুগ্ধ করে। নেপাল পর্বতারোহীদের পছন্দের দেশ হলেও সাধারণ পর্যটরাও এখানে যান হিমালয়ের পাশ থেকে সুর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে। অন্নপূর্না পর্বতের তুষার শুভ্র চূড়া দেখতেও কেউ কেউ ভিড় করেন সেখানে। প্রত্যেক বছর হাজারো পর্যটক ভ্রমণ করেন এই পাহাড়ি কন্যার দেশে।

সূর্যাস্তের সময় ফেওয়া লেকের অপার সৌন্দর্য- সংগৃহীত

এ ছাড়া কাঠমান্ডু, পাটান কিংবা ভক্তের মতো মধ্যযুগীয় শহরে ঘুরে বেড়াতেও পছন্দ করেন অনেকে। গোটা নেপালে ছড়িয়ে আছে হাজারও বছরের পুরনো মঠ আর বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের নিদর্শণের চিহ্ন, মন্দির। এ দেশের থামেল এবং পোখারার ট্রেকিংয়ের দোকান, বেকারি  কিংবা অন্যান্য দোকানে ঘুরতে ঘুরতে মনে হতে পারে আপনি ডিজনিল্যান্ডে (যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিম ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত ‘এনাহিম’ নামক নগরে আমোদ-প্রমোদের এক পার্কের নাম ডিজনিল্যান্ড) আছেন।

নেপালের কৃষি ব্যবস্থা- সংগৃহীত

নেপালের সংস্কৃতি অনেকগুলো দেশীয় আদিবাসী গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। নেপালের সংস্কৃতি হিন্দু এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির মিশ্রণে হয়েছে। নেপালের প্রধান পর্ব বিজয়া দশমী, বুদ্ধ জয়ন্তী, তিহার, ল্হোসার আদি।নেপালের রাষ্ট্রীয় পোশাক দৌরা সুরুৱাল (পুরুষ) এবং সারী (মহিলা)। নেপালের সংস্কৃতি অনেকগুলো দেশীয়, আদিবাসী গোষ্ঠীর সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে, ফলে নেপাল এক বহুসাংস্কৃতিক রাষ্ট্র। নেপালের সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ, বিশেষ করে নেওয়ার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি।‘নেওয়ার’ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি তাদের গান ও নাচের জন্য সুপরিচিত। নিচু সমতল ভূমিতে ঘরের কাঠামো তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশ, গোবর মিশ্রিত কাদা দিয়ে ঘরের দেয়াল তৈরি করা হয়। এ ধরণের ঘর শীতের দিনে বেশ গরম এবং গরমের দিনে বেশ ঠান্ডা থাকে। নেপালী বৎসর ১২ মাসে বিভক্ত এবং বছরের শুরু হয় মধ্য এপ্রিলে। নেপালে সাপ্তহিক ছুটির দিন হচ্ছে শনিবার।

নেপালের সাধারণ খাদ্য তালিকায় রয়েছে ডাল, ভাত, তরকারীর সাথে আচার বা চাটনী। নেপালের দক্ষিণাংশের জীবন আবার সম্পূর্ণই ভিন্ন রকমের। সেখানে বন্য জীবন এবং পশু-পাখি অনেক পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এ অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য রয়েছে সাফারি পার্কও। মোটরসাইকেল, গাড়ি কিংবা পর্যটন বাস –যাতে করেই আপনি দেশটি ভ্রমণ করুন না কেন এখানকার পথে-ঘাটে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। সারা বছর এখানে পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস এখানে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ এ সময় আকাশ পরিষ্কার থাকে, হিমালয়ও তার অপূর্ব সৌন্দর্য তুলে ধরে।

পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান পোখরা- সংগৃহীত

নেপালের প্রধান আকর্ষণ পাহাড়ঘেরা সারাংকোট। এ অঞ্চলটি দেশটির ২য় বৃহত্তম শহর পোখরায় অবস্থিত। নেপালের রাজধানী কাঠমুন্ডু থেকে পোখরার দূরত্ব প্রায় ২০৩ কি.মি। কাঠমুন্ডু থেকে পোখরায় যাওযা পথটির দুই ধারে চোখ জুড়ানো সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। নীল আকাশের সাদা মেঘ, সবুজ পাইনের বন, ঘন নীল আকাশটার বুকে পরিযায়ী পাাখিদের আনাগোনা- এসব যেকোনো পর্যটকের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। যাত্রাপথে সঙ্গী হবে ঘোলাটে ঘন সবুজ বন ও ত্রিশূল নদী। চারধারে পাহাড় আর পাহাড়। বনপাহাড়ের পদাবলী শুনিয়ে যায় নামা না জানা কত পাখি। পোখরা যাওয়ার পথেই ত্রিশূল নদীর পাড়ের এক ছোট্ট জনপদ চেরিস। চেরিস থেকে পোখরার দূরত্ব ৯৪ কি.মি। পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলেছে ঘন সবুজ রঙা ত্রিশূল নদী আর আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হিমালয় কন্যার আর এক নৈসর্গিক শহর পোখরা পর্যটকদের স্বাগত জানায়। পোখরা শহরটি অনেকটা পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ফেউয়া লেক। পাহাড় ও লেকের মাঝখানে এক চমৎকার শহর এই পোখরা। পোখারাকে বলা হয় ‘হেভেন অফ দ্যা নেপাল’।

হিমালয়ের জমকালো সূর্যোদয় দেখা যায় নাগরকোট থেকে। স্থানটি কাঠমুন্ডু থেকে ৩২ কি.মি. পূর্বে অবস্থিত। নাগরকোট গ্রাম পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানে অবস্থিত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের গ্রামে বসবাসকারী মানুষ মাঠ থেকে আকাশ দেখে। এখানে গেলে আপনি নিচে তাকিয়ে আকাশ দেখতে পারবেন।

পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানে ‘নাগরকোট গ্রাম’- সংগৃহীত

বন্যপ্রাণী বৈচিত্র্যা নেপালের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট। অত্যন্ত ঠান্ডা থেকে উষ্ণপ্রধান আবহাওয়ার তারতম্যের জন্য নেপালে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতে এক বিরাট বিভিন্নতা বা বৈচিত্র আছে। বন্যপ্রাণী পর্যটন এই দেশের অন্যতম পর্যটন। এখানে কিছু বন্যপ্রাণী আছে যা একমাত্র নেপালে দেখা যায় যেমন স্পিনি ব্যাব্লার। নেপালেই বিভিন্ন প্রজাতির রডোডেন্ড্রন দেখা যায়। নেপালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য অনেকগুলি জাতীয় উদ্যান স্থাপন করা হয়। যার মধ্যে গুরত্বপূর্ণ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হল সাগরমাতা রাষ্ট্রীয় উদ্যান ও চিতোয়ান রাষ্ট্রীয় উদ্যান।

নেপালের জাতীয় পাখী ‘মোনাল’- সংগ্রহীত

এই বিভাগের আরো খবর