শুক্রবার, ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আলিফ-লায়লার নগরী বাগদাদের গল্প

ডেস্ক নিউজ : বিখ্যাত বাগদাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা দ্বিতীয় আব্বাসি খলিফা আবু জাফর আল মানসুর। বাগদাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এটিই ছিল সব আব্বাসি খলিফাদের রাজধানী। অবশ্য খলিফা মামুন-অর-রশীদের শাসনামলে কিছুদিনের জন্য খোরাসান রাজধানী ছিল।

হালাকু খাঁ কর্তৃক বাগদাদ ধ্বংসের পূর্ব পর্যন্ত বাগদাদই ছিল মুসলিম বিশ্ব ও পৃথিবীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
এই নগরীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে বিখ্যাত রূপকথার গল্প ‘আলফু লায়লাতি ওয়া লায়লা’ বা আলিফ-লায়লা(দ্য এরাবিয়ান নাইটস)।

আব্বাসি খেলাফত মোট ৫২৫ বছর স্থায়ী ছিল। এই দীর্ঘ সময় ৩৬ জন খলিফা খেলাফতের মসনদে বসেন। আব্বাসি খলিফাদের মধ্যে খলিফা হারুন-অর-রশীদ আর মামুন-অর-রশীদ ছাড়া অন্য কেউই তেমন দ্যূতি ছড়াতে পারেননি।

মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের পৌত্র সেনাপতি হালাকু খাঁ কর্তৃক ৬৫৬ হিজরিতে বাগদাদ আক্রমণ করা হয় এবং খলিফা মুস্তাসিম বিল্লাহকে হত্যার মাধ্যমে খেলাফত ধ্বংস করা হয়।

এরপর যদিও মিসরের মামলুক সুলতানেরা আব্বাসি খলিফার উত্তরাধিকারীদের খলিফা হিসেবে আশ্রয় দিয়েছিল, কিন্তু তাদের ক্ষমতা ইউরোপের পোপদের মতো নামে মাত্র ছিল।

আল মনসুর যখন খেলাফতের রাজধানী হিসেবে বাগদাদকে নির্বাচন করেন তখন বাগদাদ ছোট একটি উপ-শহরের মতো ছিল। যদিও বাগদাদ পূর্বে ছিল বিশ্বখ্যাত ন্যায়পরায়ণ পারস্য শাসক নওশেরোয়ার রাজধানী।

তখন শহরটি খুব জাঁকজমক ছিল কিন্তু পরবর্তীতকালে আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে।

ঐতিহাসিকদের মতে, নওশেরোয়া শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একটি বাগান তৈরি করেন। যা পরবর্তীকালে বাগদাদ নামে প্রসিদ্ধি পায় এবং রাজধানী ঘোষণা করা হয়।

দজলা ও ফুরাত (টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস) নদীর সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় বাগদাদ ছিল আরবের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অধিক সুজলা-সুফলা। আবহাওয়া ছিল নির্মল ও অনাবিল।

সব অঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য উপযোগী। চারপাশে ছিল গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রদেশ। যথা- খোরাসান,শাম,বসরা ও কুফা। ফলে বাগদাদ ছিল আরব-অনারব,প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনস্থল।

১৪৫ হিজরীতে খলিফা আবু জাফর মনসুর বাগদাদ নগরীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তখন তিনি কুরআনের এই আয়াত পাঠ করেন,‘নিশ্চয় সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি মহান আল্লাহতায়ালা। তিনি তার বান্দাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী করে থাকেন।’

শাম,মসুল,কুফা ও কোহিস্থান প্রভৃতি অঞ্চল থেকে বড় বড় স্থপতি ও কারিগরদের ডেকে আনা হয়। প্রথম শহরের নকশা ঠিক করা হয়। মাটির নিচে ভিত্তির প্রশস্থতা ৫০ হাত আর মাটির উপরে ২০ হাত প্রশস্থ প্রাচীর তৈরি করা হয়।

পৃথিবীর মধ্যে বাগদাদ-ই একমাত্র গোলাকার শহর। শহরবেষ্টিত প্রাচীরে চার প্রদেশের নামে চারটি বাব (দরজা) রাখা হয়। বাবুল খোরাসান, বাবুশ শাম,বাবুল কুফা এবং বাবুল বসরা। এক দরজা থেকে অন্য দরজার দূরত্ব রাখা হয় এক মাইল।

উল্লেখ্য, ইমাম আযম আবু হানিফা র.কে খলিফা মনসুর খেলাফতের কাযিউল কুযাত (প্রধান বিচারপতি) হওয়ার আহ্বান করেন।

ইমাম সাহেব খলিফার নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেন ফলে খলিফা তার উপর মনক্ষুণ্ণ হন এবং শাস্তি হিসেবে তাকে নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে ইট গণনার কাজে নিযুক্ত করেন।

ইমাম আবু হানিফা র. সানন্দে তা গ্রহণ করেন যে, পূর্বের চেয়ে এই দায়িত্ব অনেক হালকা।

শহরের মধ্যে শাহী প্রাসাদ, জামে মসজিদ, কসরুজ জাহাব,কসরুল খুলদ প্রভৃতি দৃষ্টিনন্দন, শাঁনদার স্থাপত্য এবং সৌধ নির্মাণ করা হয়। ‘কুব্বাতুল খাজরা’ নামে ৮০ গজ উচ্চতার গম্বুজটি ছিল মনোমুগ্ধকর ও চিত্তাকর্ষক স্থাপনা।

শহর নির্মাণ শেষ হলে এর নামকরণ করা হয় ‘মাদীনাতুস সালাম’। তবে এই নাম জনসাধারণের কাছে প্রসিদ্ধি পায়নি, শুধু সরকারি রেজিস্ট্রারে ব্যবহৃত হতে থাকে।

মনসুরের পরবর্তী খলিফা আল মাহদি এসে বাগদাদের সম্প্রসারণ করেন। দজলা নদীর পূর্ব তীরে নতুন করে শহরকে ঢেলে সাজানো হয়। দজলা নদী বাগদাদ শহরের মধ্যে চলে আসে। ফলে শহরটি আরও চিত্তাকর্ষক ও নয়নাভিরাম হয়ে উঠে।

সময়ের তালে তালে বাগদাদ বিস্ময়কর উন্নতি করতে থাকে। খলিফা,আমির-উমরা এবং ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের নিত্যনতুন রুচির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রূপ ফুটে উঠে।

বাগদাদের সৌধগুলোর পরিচয় জানতে হলে শিবলী নুমানীর ‘ইমারাতুল ইসলাম’ পাঠ করা যেতে পারে।

খলিফা হারুন অর রশীদের উজিরে আজম জাফর বারমেকি একটি সৌধ নির্মাণ করেন যার ব্যায় খলিফা মনসুরের সমগ্র নগরী নির্মাণের চেয়েও অধিক ছিল।

বাগদাদের ‘দারুশ শাজারা’ প্রাসাদ সম্পর্কে ঐতিহাসিক গীবন লেখেন,খলিফা মুক্তার বিল্লাহ্ এই বিস্ময়কর প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। প্রাসাদের নলে পানির ফোয়ারা ছিল।তার মধ্যে স্বর্ণ নির্মিত বৃক্ষ ছিল, বৃক্ষের অনেকগুলো ডালপালা এবং তার শাখা-প্রশাখা ছিল।

এই শাখা-প্রশাখায় মহামূল্যবান হিরা-জহরত,মনি-মুক্তা এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল যে, দেখলে মনে হতো এগুলো গাছের ফুল ও ফল। আর ডাল-পালায় রঙ-বেরঙের পাখি বসিয়ে রাখা হয়েছিল। যেগুলো হাওয়ায় দোল খেয়ে বিভিন্ন গানের সুমধুর সুর তুলত।

আল্লামা শিবলী নুমানি বলেন, এককালে বাগদাদে ত্রিশ হাজার মসজিদ আর দশ হাজার হাম্মামখানা ছিল। এবং বাগদাদে ৮৬০ জন ডাক্তার প্র্যাকটিস করতেন। খলিফা হারুন-অর-রশীদের সময়ই নগরীর জনসংখ্যা দশ লাখের চেয়ে বেশি ছিল।

খলিফা মনসুরের শাসনামল থেকেই বাগদাদে গ্রীক ও সুরয়ানি ভাষার অনুবাদ শুরু হয়। হারুন-অর-রশীদের সময় বাগদাদে ‘বায়তুল হিকমাহ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।

খলিফা মামুন যিনি আব্বাসি খলিফাদের মধ্যে জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও মননশীলতায় অদ্বিতীয় ছিলেন তার আমলে বাগদাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানে উৎকর্ষ সাধন করে।

আব্বাসি আমলে বাগদাদের জ্ঞান চর্চার উদাহরণের জন্য এটিই যথেষ্ট যে, উরায়েব নামে মামুনের একজন দাসী এক হাজার রাগ (সুর) আবিষ্কার করে। জ্ঞান-প্রতিভা,মার্জিত ভাষা, সাহিত্যরসে সে ছিল অনন্য।

আরবের শেষ কবি ও ‘ইলম বদী’-এর প্রবর্তক খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ্ তার প্রতিভা ও যোগ্যতায় মুগ্ধ হয়ে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেন।

বাগদাদের এই বিশ্বয়কর উত্থান ও উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে খলিফা, উজির এবং শাসকবর্গ ভোগবাদী ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হয়ে পড়ে। বাগদাদের জীবন ও চরিত্রে ভোগ-বিলাস,খেল-তামাশার বাজার গরম হয়ে উঠে।

নাচ-গান, সুর ও সূরার মাহফিল জমজমাট হতে থাকে। সে সময়ে বাগদাদের শাহী চরিত্র জানতে হলে পড়তে হবে আবুল ফারাজ ইস্পাহানীর ‘কিতাবুল আগানী’ এবং জাহিযের ‘কিতাবুল হায়াওয়ান’।

তবে তখনও বাগদাদের জনসাধারণে ধর্মীয় চেতনা ও আবেগ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।

খতিবে বাগদাদী ‘তারিখ-ই-বাগদাদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন,তখনও বাগদাদের ঘরে ঘরে, পাড়া-মহল্লায় এবং দরবার-সমাবেশে ‘ক্বালাল্লাহু’ আর ‘ক্বালা রসূলুল্লাহ্’ এই আলোচনাই চলত।

লেখক: শিক্ষক, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ

এই বিভাগের আরো খবর