ডেস্ক নিউজ : একসময় বঙ্গদেশ তথা আজকের বাংলাদেশে মুসলিম মুদ্রা প্রচলিত ছিল। মুসলিম শাসন ব্যবস্থায় শাসকের নামে মুদ্রা প্রচলন সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। এ জন্য ক্ষমতা গ্রহণ, স্বাধীনতা ঘোষণা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজয়কে স্মরণীয় রাখার জন্য শাসকরা মুদ্রা জারি করতেন। ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে গৌড় বিজয়ের স্মরণে সেনাপতি বখতিয়ার খলজি সুলতান মুহম্মদ বিন সামের নামে গৌড় থেকে মুদ্রা জারি করেন। এটিই ছিল বাংলায় জারি করা প্রথম মুসলিম মুদ্রা। বখতিয়ার খলজির গৌড় বিজয়ের সময় থেকে বাংলায় স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠার (১৩৩৮ খ্রি.) আগ পর্যন্ত প্রায় ১৩০ বছর বাংলা দিল্লির সুলতানদের অধীন একটি প্রদেশ হিসেবে এবং পরে ২০০ বছর (১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রি.) স্বাধীন সুলতানি হিসেবে শাসিত হয়। বাংলার প্রাদেশিক গভর্নররা দিল্লি সালতানাতের মুদ্রার অনুকরণে বাংলা থেকে রাজাদের নামে মুদ্রা জারি করেন।
বাংলার টাকশাল থেকে জারি করা এযাবৎ গৌড়ের একজন ও দিল্লির ছয়জন সুলতানের নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। প্রাদেশিক গভর্নররা এ মুদ্রা জারি করতেন। যাঁদের মুদ্রা পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন মুইজউদ্দীন মুহম্মদ বিন সাম (১২০৩-১২০৬ খ্রি.), সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুিমশ (১২১০-১২৩৬ খ্রি.), সুলতান জালালউদ্দীন রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রি.), সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ (১২৪৬-১২৬৬ খ্রি.), সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রি.), সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক (১৩২০-১৩২৫ খ্রি.) ও সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১ খ্রি.)। তাঁদের মধ্যে মুহম্মদ বিন সাম ও ইলতুিমশ স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা জারি করেন। বাকি সবার রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। একমাত্র মুহম্মদ বিন তুঘলকের স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রা পাওয়া গেছে।
সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের মুদ্রার পাণ্ডুলিপিতে ‘তানকাহ’ (সংস্কৃত টঙ্কা) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয়েছে। এসব রৌপ্যমুদ্রার সব কটি ছিল পূর্ণ টাকা, মোটামুটি এক ভরি ওজনের। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণভাবে বাংলায় কোনো অর্ধ, সিকি প্রভৃতি নিম্নমানের মুদ্রা পাওয়া যায়নি। কেননা কড়ি এজাতীয় প্রয়োজন মেটাত।
দিল্লির চারজন সুলতান ও বাংলার চারজন গভর্নরের যুক্ত নামে প্রকাশিত মুদ্রা পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন (১) গভর্নর দৌলত শাহ বিন মওদুদ, সুলতান ইলতুিমশের সঙ্গে, (২) গভর্নর ইখতিয়ারুদ্দীন, সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদের সঙ্গে, (৩) গভর্নর নাসিরুদ্দীন ইবরাহিম, সুলতান গিয়াসউদ্দীন তুঘলক ও সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে এবং (৪) গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর, সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে। এর সব কটি রৌপ্যমুদ্রা। তবে গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর ও মুহম্মদ বিন তুঘলকের স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গেছে।
এসব মুদ্রার একদিকে কখনো কখনো আব্বাসীয় খলিফা ও সুলতানের নাম এবং অন্যদিকে গভর্নরের নাম অথবা একদিকে শুধু আব্বাসীয় খলিফার নাম এবং অন্যদিকে সুলতান ও গভর্নরের নাম অথবা একদিকে দিল্লির সুলতানের এবং অন্যদিকে উপাধিসহ গভর্নরের নাম এবং প্রান্তে টাকশাল ও তারিখ স্থান পেয়েছে।
১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দ (৮৩৮ হি.) থেকে পরবর্তী ইলিয়াসশাহী বংশের মোট পাঁচজন সুলতান (১) নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯ খ্রি.), (২) রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রি.), (৩) শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-১৪৮১ খ্রি.), (৪) নূরুদ্দীন সিকান্দার শাহ (১৪৮১ খ্রি.) এবং (৫) জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ (১৪৮১-১৪৮৭ খ্রি.)-এর রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে নূরুদ্দীনের মুদ্রা সাম্প্রতিককালের আবিষ্কার এবং মুদ্রার ভিত্তিতে তাঁর প্রকৃত পরিচয় জানা গেছে। তিনি মাহমুদ শাহর পুত্র এবং বারবক ও ফতেহ শাহর ভাই। খুবই অল্পকাল তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।
অতঃপর হাবশি বংশের চারজন শাসক, শাহজাদা বারবক (১৪৮৭-১৪৮৮ খ্রি.), সাইফুদ্দীন ফিরুজ (১৪৮৮-১৪৯০ খ্রি.), কুতুবউদ্দীন মাহমুদ (১৪৯০ খ্রি.), শামসুদ্দীন মুজাফফর (১৪৯০-১৪৯৩ খ্রি.) রাজত্ব করেন।
তাঁদের মধ্যে শাহজাদা বারবক ও কুতুবউদ্দীনের মুদ্রা কম পাওয়া যায়। মুজাফফর শাহর কামতা বিজয়ের স্মারক মুদ্রা, (‘কামতামরদান’ ৮৯৮ লিপি সংবলিত) সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। হাবশিদের পরে হোসেনশাহী বংশের চারজন শাসকের স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রি.), নাসিরুদ্দীন নুসরত শাহ (১৫১৯-১৫৩২ খ্রি.), আলাউদ্দীন ফিরুজ (১৫৩২ খ্রি.) ও গিয়াসউদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩-১৫৩৮ খ্রি.), একমাত্র নুসরত শাহর কয়েকটি তাম্রমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।
বাংলার মুসলমানদের মুদ্রা সাধারণত গোল আকৃতির। অবশ্য জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহর একটি ষড়ভুজ আকৃতির ব্যতিক্রমী মুদ্রা পাওয়া গেছে। ওজনের দিক থেকে বাংলার সুলতানি মুদ্রা প্রথমত দিল্লির মুদ্রার অনুকরণে ১৭৭ গ্রেন বা ১১.৬ গ্রাম ওজন মূল্যমান গৃহীত হয়েছিল; কিন্তু পরে মুদ্রার ওজন কমে দাঁড়ায় ১৬৬ গ্রেন বা ১০.৮ গ্রামে।
স্বর্ণমদ্রা তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় কম এবং একমাত্র বড় বড় লেনদেনে, স্মারক ও স্যুভেনির হিসেবে ব্যবহার করা হতো। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সাধারণত রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল।
উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিকের সময়ে মুদ্রায় কলেমার ব্যবহার শুরু হয়। পরে মুসলিম শাসকদের মুদ্রায় কলেমার ব্যবহার বহুলভাবে দেখা যায়।
বাংলার মুদ্রায় মুসলিম খিলাফতের চার ধরনের প্রকাশ দেখা যায়—
(১) মুদ্রায় সরাসরি খলিফার নাম উল্লেখ। যেমন—গিয়াসউদ্দীন খলজির ৬১৯ অথবা ৬১৭ হিজরি (১২২২ বা ১২২০ খ্রি.) ও ৬২১ হিজরির (১২২৪ খ্রি.) মুদ্রা।
(২) আব্বাসীয় খলিফাদের নাম অনুপস্থিত ছিল; কিন্তু খিলাফতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হয়। যেমন—৭৮১ হিজরিতে (১৩৭৯ খ্রি.) সুলতান সিকান্দর শাহ (১৩৫৮-১৩৯০ খ্রি.) প্রবর্তিত মুদ্রার গৌণ দিকে উত্কীর্ণ রয়েছে ‘ইয়ামিন খলিফাতুল্লাহ নাসির আমির আল মুমিনিন শামসুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন খুল্লিদাত খিলাফাতাহু’।
(৩) মুদ্রায় কলেমা ও নবী (সা.)-এর প্রতি আনুগত্য বা সম্পর্কসূচক লিপির উদ্ধৃতি। যেমন—আলাউদ্দীন হোসেন শাহর ৮৯৯ হিজরিতে (১৪৯৩ খ্রি.) উত্কীর্ণ মুদ্রার মুখ্য দিকে রয়েছে কলেমা এবং গৌণ দিকে উত্কীর্ণ রয়েছে ‘আস সুলতান আল আদীল আল বাযিল ওয়ালাদ-ই সাইয়িদ উল মুরসালিন’।
(৪) মুদ্রায় নিজেকে খলিফা ঘোষণা করা। যেমন—সুলতান জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহর ৮৩১ হিজরিতে (১৪২৭ খ্রি.) উত্কীর্ণ মুদ্রার গৌণ দিকে বৃত্তের ভেতর লেখা রয়েছে ‘খলিফাতুল্লাহ নাসির আল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন’।
বাংলার সুলতানি শাসকরা মুদ্রাকে জনগণের জন্য সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে টাকশালের বিকেন্দ্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেন। রাজধানী ছাড়াও দেশের প্রশাসনিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাকশাল স্থাপন করে সেখান থেকে তাঁরা মুদ্রা প্রকাশ করেন। সুলতানি আমলের ২৭টিরও বেশি টাকশালের নাম পাওয়া যায়। (বাংলাপিডিয়া)