মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এ সময়ের সেরা ধনীরাও মানসা মুসার রেকর্ড ভাঙতে পারেননি!

ডেস্ক নিউজ : বর্তমান যুগে আফ্রিকার দেশগুলোকে সবচেয়ে দারিদ্রতম দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অথচ ইসলামী খেলাফতের সময় এটি বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। অনেকের জানা নেই, বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনী রাজা ছিলেন একজন মুসলিম। এবং তিনি ছিলেন বর্তমানের দারিদ্রতম রাষ্ট্র মালির রাজা মানসা মুসা। একসময় মালির রাজাদের উপাধি ছিল মানসা, যার অর্থ হচ্ছে রাজা বা সম্রাট। মুসা ছিলেন দশম মানসা, অর্থাৎ মালি সাম্রাজ্যের দশম সম্রাট। মুসার জন্ম ১২৮০ সালে। ১৩১২ সালে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি ক্ষমতায় আরোহণ করেন।

বিংশ শতাব্দীতে এসে বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট অথবা রথসচাইল্ড ফ্যামিলিসহ বহু ধনীই পরিচিত। কিন্তু তাঁরা কেউই চৌদ্দ শতকের মালির মুসলিম শাসক মানসা মুসাকে অতিক্রম করতে পারেননি। মূল্যস্ফীতি হিসাব করে তাঁর তৎকালীন সম্পত্তি বর্তমান মুদ্রায় রূপান্তর করলে সেটার পরিমাণ হবে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে রথসচাইল্ড ফ্যামিলির সম্পত্তির মূল্য ৩৫০ বিলিয়ন ডলার, আর বিল গেটসের সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র ৯০ বিলিয়ন ডলার!

মানসা মুসা তাঁর শাসনামলে বর্তমান সময়ের মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, নাইজেরিয়া, চাদ, আইভরি কোস্টসহ ২৪টি শহর এবং এদের আশপাশের গ্রামাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা জয় করেছিলেন।

১৩২৪ সালে বিশ্বের এই প্রভাবশালী ধনী মুসলিম সম্রাট বহির্বিশ্বের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তিনি প্রায় চার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে হজ করতে যান। তাঁর সফরসঙ্গী হিসেবে ছিল প্রায় ৬০ হাজার মানুষের এক বিশাল বহর। যাদের মধ্যে প্রায় ১২ হাজার ছিল সৈন্য ও দাস। দাসদের প্রত্যেকের কাছে ছিল চার পাউন্ড করে সোনার বার। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে ছিল ৮০টি উট, যাদের প্রত্যেকের পিঠে ৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ড করে সোনা ছিল।

হজযাত্রায় পথে পথে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ অকাতরে বিলি করার মাধ্যমে তিনি পশ্চিমা বণিকদের নজরে আসেন। সেই সফরে তিনি গরিবদের মুক্ত হস্তে দান করেন এবং শহরগুলোর শাসকদেরও প্রচুর স্বর্ণ উপহার দেন। তিনি মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে এত বেশি পরিমাণ অর্থ ও স্বর্ণ ব্যয় করেন যে মিসরের স্বর্ণবাজারে বিশাল মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং অর্থনীতিতে ধস নামে। এটা জানতে পেরে ফেরার পথে মুসা মিসরের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে স্বর্ণ ধার নেন। কিন্তু এর পরও মিসরের স্বর্ণের বাজার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় এক দশক সময় লেগেছিল।

তাঁর এই হজযাত্রা তাকে আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে দিয়েছিল। পরবর্তী কয়েক দশক ধরে ইউরোপিয়ান মানচিত্র প্রস্তুতকারকরা আফ্রিকার যতগুলো মানচিত্র তৈরি করেছেন, তার প্রায় সবগুলোতে মুসার কথা উল্লেখ করেছিলেন। একটি বিখ্যাত মানচিত্র হলো ১৯৩৯ সালে তৈরি ইতালির কাতালান অ্যাটলাস, যেখানে পশ্চিম আফ্রিকার মানচিত্রের ওপর মুসাকে একটি স্বর্ণদণ্ড হাতে দেখা যায়।

ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। হজ পালন শেষে দেশে ফেরার সময় সম্রাট মুসা তাঁর সঙ্গে অনেক ইসলামিক স্কলার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং আন্দালুস ও কায়রো থেকে অনেক বিখ্যাত স্থপতিকে নিয়ে আসেন। তাদের দ্বারা মুসা তিম্বাকতু, গাওসহ বিভিন্ন শহরকে আধুনিকায়ন করেন, প্রচুর সুরম্য মসজিদ, মাদরাসা, লাইব্রেরি এবং বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেন এবং ইসলামী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটান।

জ্ঞানচর্চায় মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পর তাঁর নির্মিত সানকোর বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতেই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইয়ের সংগ্রহ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং এক লাখ পাণ্ডুলিপি ছিল। তাঁর শাসনামলে তিম্বাকতু সাব-সাহারান আফ্রিকা ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তাঁর কল্যাণে এ সময় ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে।

দীর্ঘ ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৩৩৭ সালে সম্রাট মুসা মৃত্যুবরণ করেন। এক কালের সমৃদ্ধ দেশ পরবর্তী সময়ে মুসলিমদের হাতছাড়া হয়। এবং বিশ্বের দারিদ্রতম দেশগুলোর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়।

সূত্র : বিবিসি ও দি মুসলিম ভাইব ডটকম

এই বিভাগের আরো খবর